মুক্তিপণ আদায়ে নতুন কৌশল নিয়েছে অপহরণকারীরা। তারা ব্ল্যাকমেইল করে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে। রাজধানীর মগবাজার থেকে একজন ব্যবসায়ীকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত দুই অপহরণকারী গ্রেফতারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি একথা জানিয়েছে।
কালিপদ দাস (৬০)তিন ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে মগবাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। মগবাজার মোড়ে তার একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা রয়েছে। বড় ছেলে, তিনজন কর্মচারী ও তিনি নিজেই এই বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেন। গত ১৩ নভেম্বর সকালে দু’জন ব্যক্তি এক হাজার বিলবোর্ড তৈরি করানোর অর্ডার দেওয়া হবে বলে কালিপদ দাসকে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে তুলে পশ্চিম রামপুরার একটি বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আটকে তাকে মারধর করে এবং বিবস্ত্র করে এক নারীর সঙ্গে ছবি তুলে ব্যবসায়ীর পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। ব্যবসায়ীর পরিবার বিষয়টি হাতিরঝিল থানায় জানানোর পর পুলিশ অপহরণকারীদের মোবাইল ট্রাকিং করে রামপুরা থেকে কালিপদকে উদ্ধার করে। দুই অপহরণকারী হানিফ ও শামীমকে গ্রেফতার করে।
হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু ফজলুল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই ঘটনায় ভিকটিমের বড় ছেলে বাদী হয়ে ১৪ নভেম্বর একটি অপহরণ মামলা করেন। গ্রেফতার হানিফ ও শামীম আদালতে তাদের দোষ স্বীকার করে জবানবন্ধি দিয়েছে। তবে এখনও কয়েকজন আসামি পলাতক রয়েছে, তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
পুলিশ জানিয়েছে, প্রতিদিনের মতো ১৩ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় মগবাজার মোড়ে নিজের বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানে যান কালিপদ। তখনও সেখানে তার বড় ছেলে আসেননি। তিন কর্মচারীদের মধ্যে একজন এসেছিলেন। সকাল পৌনে ১০টার দিকে দু’জন ব্যক্তি এসে জানান, তারা ‘ক্রানতি’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার জন্য বিভিন্ন সাইজের প্রায় একহাজার বিলবোর্ড তৈরি করতে হবে। এই সংখ্যক বিলবোর্ড তৈরি করতে কী পরিমাণ সময় লাগবে এবং বিলবোর্ড প্রতি কত টাকা দিতে হবে তা নিয়ে কালি পদ দাসের সঙ্গে তারা আলোচনা করেন। এরপর এই দুই ব্যক্তি তাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কালি পদ দাসকে মোবাইলে কথা বলিয়ে দেন। তখন চেয়ারম্যান পরিচয় দেওয়া লোকটি ব্যস্ততার কারণে নিজে না আসতে পারায় দুঃখ প্রকাশ করে রতন সরকারকে হাতিরঝিল থানাধীন পশ্চিম রামপুরা এলাকায় তাদের অফিসে চূড়ান্ত কথা বলতে আমন্ত্রণ জানায়। এত বড় অর্ডার পাবেন ভেবে কালিপদ তার ছেলেকে দোকানে আসতে বলে ওই দুই ব্যক্তির সঙ্গে সিএনজিতে উঠেন। তারা পশ্চিম রামপুরার উলন এলাকায় যায়। সেখানে একটি বাসায় তাকে আটকে রধর করা হয়। ১৩ নভেম্বর বিকাল সোয়া ৫টার দিকে কালিপদর স্ত্রীর মোবাইল ফোনে অপহরণকারীর ফোন দিয়ে তিনলাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ পাঠাতে ১৫টি বিকাশ নম্বর দেয় চক্রটি। মুক্তিপণ না দিলে এই ব্যবসায়ীকে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দেয়। এসময় তার স্ত্রী-স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তার সঙ্গে অপহরণকারীরা কথা বলিয়ে দেয়। স্ত্রীকে তিনি টাকা দিয়ে তাকে মুক্ত করতে অনুরোধ করেন। মুক্তিপণ দেওয়ার জন্য অপহরণকারীরা একঘণ্টা সময় দেয় তার স্ত্রীকে।
অপহরণে জড়িত আসামি হানিফ ও শামীম
ব্যবসায়ী কালিপদর স্ত্রী উপায় না পেয়ে হাতিরঝিল থানায় ছুটে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বিস্তারিত ঘটনা পুলিশকে খুলে বলেন। এরপর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক বিষয়টি তদারকি শুরু করেন। অপহরণকারীদের অবস্থান শনাক্ত করতে ট্রাকিং শুরু করেন। ১৪ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) সালমান হাসানের নেতৃত্বে হাতিরঝিল থানার একটি টিম ব্যবসায়ী কালিপদ দাসকে আফতাব নগর এলাকার শেষ মাথা থেকে ওই ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করে। এসময় অপহরণকারী চক্রের দু’জন সদস্য হানিফ ও শামীমকে গ্রেফতার হয়।
উদ্ধারের পর কালিপদ পুলিশকে জানায়, ১৩ নভেম্বর সকালে তাকে পশ্চিম রামপুরার উলনের একটি বাসায় রাখা হয়। সেখানে নেওয়ার প্রায় আধা ঘণ্টা পর ঝর্ণা নামে এক তরুণী বাসায় প্রবেশ করে। এরপর চক্রটি দরজা বন্ধ করে দেয়। মেয়েটিকে আপত্তিকর অবস্থায় ব্যবসায়ীর সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দুই ব্যক্তি মোবাইলে ছবি তুলে। এসময় বাসার কলিং বেল বেজে উঠে পুলিশ পরিচয়ে সিভিলে এক ব্যক্তি প্রবেশ করে। বাসার ভেতরে এক তরুণীকে আটকে রেখে ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে বলে সবাইকে গ্রেফতারের ভয় দেখায়। তখন ওই তরুণী কান্না করতে থাকে। এসময় সেখানে সাংবাদিক পরিচয়ে এক ব্যক্তি প্রবেশ করে। এরপর আরও দুই ব্যক্তি নিজেদের ওই এলাকার লোক পরিচয়ে বাসায় প্রবেশ করে।
এসময় সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি কালিপদর পরিবারকে বিষয়টি জানাবে বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে। তাদের এসব ছবি দেখানো হবে। তখন ভিকটিম ব্যবসায়ী এসব ছবি তার পরিবারকে না জানানোর জন্য বলে মেয়েটি আরও কান্না শুরু করে, কারণ এসব ছবি প্রকাশ হলে তার সংসার ভেঙে যাবে। তাদের অনুরোধে পুলিশ ও সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া দুই ব্যক্তি সবার উপস্থিতিতে ওই তরুণীর সঙ্গে বিষয়টি মীমাংসা করানোর কথা বলে। টাকা-পয়সা দিয়ে মীমাংসা করতে তারা ব্যবসায়ীকে চাপ দিতে থাকে।
কালিপদ জোরে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন চক্রটি তার চোখ-মুখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। অপহরণকারীদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাঁচাতে স্ত্রীকে ফোন করে আকুতি জানায় দাবিকৃত টাকা দিয়ে দিতে। স্ত্রী এই চক্রটিকে বিকাশের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েও দিয়েছিলেন। এদিকে পুলিশ তাকে উদ্ধারে ততক্ষণে অভিযানে নেমেছে। ঘটনার প্রায় ২৬ ঘণ্টা পর পুলিশ তাকে আফতাব নগর থেকে উদ্ধার করে।
এ ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার এসআই রেজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশের অভিযানে গ্রেফতারকৃত ভুয়া পুলিশ হানিফ ও ভুয়া সাংবাদিক এনাম রসুল খন্দকার শামীমকে গ্রেফতার করা হয়। তারা আদালতে স্বীকারাক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত জয়, হানিফের স্ত্রী শিউলি এবং ঝর্ণা নামে ওই প্রতারক তরুণী এখনও পলাতক। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অপহরণ চক্রটি প্রথমে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এজন্য সেভাবে তারা সার্থক না হয়ে ব্যবসায়ীকে হত্যা মারধর করে মুক্তিপণ আদায় করতে চেয়েছিল। তবে বড় কোনও কিছু না ঘটার আগেই পুলিশ ভিকটিমকে উদ্ধার করেছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন