বাংলাদেশ ও মিয়ানমার—প্রস্তুত ছিল দুই দেশই। আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিকেল পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল বাস। কিন্তু যাদের যাওয়ার কথা তারাই রাজি হলো না। কেউ কেউ উপস্থিত হয়ে না ফেরার কথা জানাল। আর কেউ কেউ প্রত্যাবাসন এড়াতে আগেই পালায়। আর এভাবেই বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুতেই হোঁচট খেল।
গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা দফায় দফায় চেষ্টা করলেও রোহিঙ্গারা একযোগে স্লোগান ধরে বলে, ‘আঁরা ন-যাইয়্যুম, আঁরা ন-যাইয়্যুম (আমরা যাব না, আমরা যাব না)।’
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রথম দফার প্রত্যাবাসন কাজে সফলতা না এলেও পরবর্তী সময়ে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য রোহিঙ্গাদের উদ্বুদ্ধ করা হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের প্রত্যাবাসন উদ্যোগ নিয়ে ব্রিফ করার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, রোহিঙ্গা ‘মাঝিদের’ (নেতাদের) রাখাইন সফরে পাঠানোর একটি পরিকল্পনা সরকার বি্বেচনা করছে। তারা সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে এসে অন্য রোহিঙ্গাদের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরতে পারবে। এ প্রস্তাবটি দিয়েছে জাপান। বাংলাদেশ এটি নিয়ে আগামী দিনে কাজ করবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জোর করে ফেরত পাঠাবে না। তবে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও বলেছেন, রোহিঙ্গারা বেশি দিন থাকলে সমস্যা আরো বাড়বে।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গতকাল প্রথম দফায় ৩০টি পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গার নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। এ জন্য কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কর্মকর্তারা যাবতীয় প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছিলেন। দুপুর ১২টায় ঘুনধুমের প্রত্যাবাসন কেন্দ্র দিয়ে তাদের দেশে ফেরার কথা ছিল।
ওই ১৫০ জন রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি শিবিরের মধ্যে দুটি শিবিরের বাসিন্দা। শিবির দুটি হচ্ছে, টেকনাফের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা শিবির এবং উখিয়ার জামতলী রোহিঙ্গা শিবির। গতকাল দুপুর ১২টার সময় উনচিপ্রাং শিবিরের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত ১৭টি পরিবারের সদস্যদের ডেকে নিয়ে আসা হয় শিবিরের কার্যালয়ে। সেখানে আরআরআরসির মোহাম্মদ আবুল কালাম ও ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে ওই রোহিঙ্গাদের কাছে দেশে ফেরার ব্যাপারে মতামত জানতে চাওয়া হয়। রোহিঙ্গারা তখন সবাই একযোগে স্লোগান ধরে, ‘আঁরা ন-যাইয়্যুম, আঁরা ন-যাইয়্যুম।’
আরআরআরসি আবুল কালাম রোহিঙ্গাদের জানান, যারা দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক তাদের প্রত্যেককে তিন দিনের খাবার দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে চিকিৎসা সহায়তাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হবে। কিন্তু রোহিঙ্গা সবারই একই কথা, তারা যাবে না।
এরপর আরআরআরসি জামতলী রোহিঙ্গা শিবিরে প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত ১৩টি পরিবারের সদস্যদের দেশে ফিরতে ইচ্ছুক কি না জানার চেষ্টা করে। সে সময় ১৩ পরিবারের মাত্র একজন সদস্য ছাড়া কেউই উপস্থিত হয়নি। একমাত্র উপস্থিত রোহিঙ্গা নুরুল আমিন কালের কণ্ঠকে জানান, মিয়ানমারে ফেরা এড়াতে তিন দিন আগেই এসব পরিবারের সব সদস্য গাঢাকা দিয়েছে।
এরপর আরআরআরসি ঘুনধুমের প্রত্যাবাসন কেন্দ্রে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও ফিরতে আগ্রহী কোনো রোহিঙ্গাকে পাওয়া যায়নি। ফলে সেখানেই থমকে যায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ। তবে আবুল কালাম কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের মোটিভেশনের (উদ্বুদ্ধ করার) মাধ্যমে দেশে ফেরানোর কাজ আবারও শুরু করা হবে।’
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে গত বছর নভেম্বর মাসে। গত এক বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। অথচ গত বছরের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইনে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বরাবরই দেশে ফেরার আগ্রহ জানিয়ে আসছে। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল রোহিঙ্গাদের না ফিরতেই উদ্বুদ্ধ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিবিরগুলোতে বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) ছদ্মাবরণে থাকা শত শত লোক মূলত নিজেদের ব্যবসা, জীবিকা ও স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরতে নিরুৎসাহ করছে। দুই দিন ধরে রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে আরো জানা গেছে, গত বছরের আগস্ট মাসের পর থেকে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি কোনো পক্ষই উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি হাতে নেয়নি। আবার প্রত্যাবাসনের কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারে পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ার অজুহাত তুলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনবিরোধী করে তুলেছে। এর ফলে প্রত্যাবাসনের কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে চুক্তির পরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে না পারায় মিয়ানমার বাংলাদেশকে দুষছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন