কেউ কৃষক, কেউ দর্জি, কেউ আবার করেন রড ঢালাইয়ের কাজ। কিশোরগঞ্জ জেলার এমন সাত জনকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ কুয়েত পাঠানোর স্বপ্ন দেখায় ‘সেবা ট্রাভেলস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের কথা অনুযায়ী ওই সাত জন আড়াই থেকে সাড়ে ৩ লাখ করে টাকাও দেয় এজেন্সিকে। কিন্তু বিষয়টি যে ছিল শুধুই প্রতারণা, তা খোলাসা হয় ধীরে ধীরে।
প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন কিশোরগঞ্জের কাঞ্চন মিয়া, আলাল মিয়া, আলমাস মিয়া, আবদুর রাজ্জাক, হুমায়ুন, মিজানুর রহমান ও রাসেল মিয়া। তাদের বেশির ভাগই যুবক।
প্রতারণার অভিযোগ এনে তারা রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় একটি মামলা করেন। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ অক্টোবরের পর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ওই থানাধীন নিকুঞ্জ এলাকার ট্রাভেল এজেন্সিতে অভিযান চালায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
ওই অভিযানে এজেন্সির সঙ্গে জড়িত ১০ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট ও সাত লাখ ৯৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
পুরো বিষয়টি তদন্ত করছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট। তাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ‘সেবা ট্রাভেলস’ নামের প্রতিষ্ঠানটির কোনো অনুমোদন নেই। কিন্তু তারা কুয়েতে নেওয়ার কথা বলে প্রত্যেককে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা করে দিতে বলেছিল। সে অনুযায়ী, ওই সাত জন অর্ধেকের বেশি টাকা পরিশোধ করেন। বাকি টাকা কুয়েতে যাওয়ার পর পরিশোধ করার কথা ছিল।
প্রিয়.কমের অনুসন্ধানে জানা যায়, গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো প্রতারিত হতে যাওয়ার বিষয়টি শুরুতে বুঝতে পারেননি। কিন্তু টাকা দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি বিদেশে পাঠানোর নামে যখন টালবাহানা শুরু করে, তখন কয়েকজনের সন্দেহ হয়। সেই সন্দেহ থেকেই বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা। তারা বিষয়টি যাচাই করার জন্য চলে আসেন ঢাকায় অবস্থিত কুয়েত দূতাবাসে। সেখানে কর্মকর্তাদের কাছে জানতে পারেন, তাদের যে ভিসা দেওয়া হয়েছে, সেই একই ভিসা পাওয়া ব্যক্তিরা ইতোমধ্যে কুয়েত চলেও গেছেন। শেষে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির কোনো নিবন্ধনও নেই। পরে তারা মামলা করেন।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে আলমাস ২ লাখ ৭৫ হাজার, আলাল মিয়া তিন লাখ ৬০ হাজার, হুমায়ুন ২ লাখ ৪০ হাজার, আবদুর রাজ্জাক ৩ লাখ ১০ হাজার, মিজানুর রহমান আড়াই লাখ, রাসেল মিয়া ২ লাখ ২৯ হাজার এবং কাঞ্চন মিয়া আড়াই লাখ টাকা দেন। প্রমাণ হিসেবে তারা ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেওয়া রশিদগুলো সংগ্রহে রেখেছিলেন।
এর সূত্র ধরে পরবর্তী সময়ে নিকুঞ্জে ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে অভিযান চালায় সিআইডি। এতে উদ্ধারকৃত টাকা সাত জনের মধ্যে সমহারে বণ্টন করে দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীরা জানান, ট্রাভেল এজেন্সির আচরণে সন্দেহ হলে তাদের কয়েকজন কিশোরগঞ্জ থেকে গত ২৬ আগস্ট ঢাকায় চলে আসেন এবং কুয়েত দূতাবাসে সেগুলো দেখান। সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, এই ভিসা ইস্যুকারী ব্যক্তিরা কিছুদিন আগেই কুয়েত চলে গেছেন। এ কথা জানার পর তারা দ্রুত খিলক্ষেত থানায় যান এবং একটি মামলা করেন।
বিষয়টি তদন্ত করে সত্যতা পায় সিআইডির টিম। পরে এ ঘটনায় জড়িত থাকায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। কয়েকজন পলাতক। তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চালানোর কথা জানিয়েছে সিআইডি।
প্রতারিক যুবক রাসেল মিয়া জানান, তারা প্রতারিত হচ্ছেন, বিষয়টি প্রথম দিকে বুঝতেই পারেননি। পরে তাদের কেউ একজন ঢাকায় আসেন এবং বিষয়টি যাচাই করেন। তখন তারা জানতে পারেন, ট্রাভেল এজেন্সি তাদের বিদেশ পাঠানোর নাম করে প্রতারণা করেছে।
কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন বয়সী ওই ব্যক্তিরা মামলার আগে গিয়েছিলেন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন সংশ্লিষ্টদের কাছে। তাদের কথা শুনে ব্র্যাক বিষয়টি যাচাই শুরু করে।
ব্র্যাকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, শুধু সেবা ট্রাভেল এজেন্সি নয়, তাদের মতো আরও কিছু প্রতিষ্ঠান এভাবে কুয়েতের ভিসা জালিয়াতি করে প্রতারণা করছে মানুষের সঙ্গে, হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এই চক্রটি এর আগেও লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা জালিয়াতি করে লোক পাঠানোর নামে প্রতারণা করেছে।
কুয়েতের অনলাইন ভিসা দিয়ে ট্রাভেল এজেন্সির অনেকে প্রতারণা করছেন। বিষয়টি এতদিন অনেকের কাছে অজানা ছিল। কিন্তু সেবা ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে লোকজন প্রতারিত হওয়া সেই সাত ব্যক্তির মধ্য দিয়ে বিষয়টি চাউর হয়।
ব্র্যাকের অভিবাসন শাখার কর্মকর্তারা সেই ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরােতে গত ২৮ অক্টোবর একটি চিঠি দেন। এ ছাড়াও বিষয়টি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও জানিয়ে চিঠি দিয়েছে।
চিঠিতে অনলাইনে কুয়েতের ভিসা যাচাই প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণের বিষয়টি উল্লেখ করেছে ব্র্যাক।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের হেড অব প্রোগ্রাম শরিফুল হাসান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা বলি যে, যারা বিদেশ যাচ্ছেন, প্রথম কাজ হবে প্রতিষ্ঠানটির আরএল (রিক্রুটিং লাইসেন্স) আছে কি না, সেটা চেক করা। এ ছাড়াও তারা কাকে টাকা দিচ্ছেন, কত টাকা দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন, এসব বিষয় যাচাই-বাছাই করে তারপর বিদেশ যাওয়া।’
তদন্তকারী সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের রমনা শাখার পরিদর্শক মাইনুল ইসলাম প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা ভিসার জালিয়াতি রোধে কুয়েত অ্যাম্বাসিকে (দূতাবাস) বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছি। তারা হয়তো খুব শিগগিরই বিষয়টির জবাব দেবেন। তবে এই মামলায় এখন পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। প্রতারিত ব্যক্তিদের মাঝে উদ্ধারকৃত টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।’
সিআইডির ভাষ্য, ট্রাভেল এজেন্সির ভিসা জালিয়াতি হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশের ভিসা চেক করার ক্ষেত্রে যার নামে ভিসা ইস্যু হয়েছে, অনলাইনে তাদের নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও ছবিসহ অন্যান্য সব তথ্য দেখার সুযোগ আছে। কুয়েত সরকারের অনলাইনে ভিসা চেকিংয়ের ক্ষেত্রটা ভিন্ন।
যে প্রতিষ্ঠানই এই ভিসা যাচাই করুক না কেন, শুধু ভিসার অ্যাপ্লিকেশন স্ট্যাটাস সঠিক কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া ছাড়া আর কিছু যাচাই করা সম্ভব হয় না। এ কারণে খুব সহজে এই ভিসা জালিয়াতি হচ্ছে। ভিসা ইস্যুকারী ব্যক্তির নাম, ছবি ও পাসপোর্ট নম্বর না থাকায় একজনের ভিসা অন্যজনের বলে চালিয়ে দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন