সেলিম ওসমান নিজে আমার কানে থাপ্পড় মেরে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। তার ওই থাপ্পড়ের কারণে আমি এখন দুই কানে শুনতে পাই না। কানে হিয়ারিং এইড লাগিয়ে আমাকে চলতে হচ্ছে। তাই আমি এমন একটি আদেশ চাই যাতে আমার ওই ক্ষত দূর হয়’।
আজ মঙ্গলবার আদালতে চার্জ শুনানির সময় এসব কথা বলেন শিক্ষক শ্যামল কান্তি।
শুনানিকালে ওই ঘটনায় ছেড়া জামা-কাপড় আদালতে উপস্থাপন করেন শ্যামল কান্তি।
এসময় রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুলও শ্যামল কান্তির বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর। তাদের এভাবে অপমান করা মানে গোটা জাতিকে অপমান করা। যেহেতু মামলার জুডিশিয়াল প্রতিবেদনে দুইজনের বিরুদ্ধেই শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে মারধর করে আহত করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই উভয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হোক।
অন্যদিকে আসামি সেলিম ওসমানের পক্ষে অ্যাডভোকেট সিদ্দিকুর রহমান ও মোজাম্মেল হক বলেন, জুডিশিয়াল প্রতিবেদনে কানে থাপ্পড় মারার সত্যতা প্রকাশ পায়নি। সেখানে শুধু কান ধরে উঠবস করার কথা বলা হয়েছে। আর সেলিম ওসমান তা করেছিলেন জনরোষ থেকে শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে বাঁচানোর জন্য। যার মাধ্যমে তিনি বরং শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে বাঁচিয়েছেন। তাই তার অসৎ কোনো উদ্দেশ্য না থাকায় তাকে অব্যাহতি প্রদান করা হোক।
শুনানি শেষে বিচারক আসামি সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার মতো কোনো উপাদান না থাকায় তাকে অব্যাহতি প্রদান করেন।
অন্যদিকে আসামি মো. অপুর (স্থানীয় সামসু্ল হকের ছেলে) বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দণ্ডবিধির ৩২৩ ধারায় অভিযোগ গঠন করেন।
আদালত সেলিম ওসমানকে অব্যাহতির আদেশ দেওয়ার পর শিক্ষক শ্যামল কান্তি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমিন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি।’
এর আগে গত ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলাটি নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে ঢাকার সিজেএম আদালতে বিচারের জন্য বদলির নির্দেশ দেন। এরপর আদালত দণ্ডবিধির ৩২৩/৩৫৫/৫০০ ধারায় মামলাটি আমলে গ্রহণ করেন।
হাইকোর্টের বিচারপতিদ্বয় আদেশে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে দেশের আইন নিরপেক্ষ ও বৈষম্য ছাড়া প্রয়োগ করা। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না।
কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন, সবাই আইনের অধীন এটি আইনের শাসনের মর্মবাণী। বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা ওই ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছি। বিচারের স্বার্থে এটি যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয়।
তারা বলেন, বিচারক তদন্ত প্রতিবেদনে ছয়টি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এগুলো হলো—
১) শ্যামল কান্তি ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ রিফাত হাসানকে ২০১৬ সালের ৮ মে মারধর করেছেন তা প্রমাণিত।
২) ইসলাম ধর্ম ও আল্লাহকে নিয়ে শ্যামল কান্তির কটূক্তির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
৩) ২০১৬ সালের ১৩ মে ওই স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভা চলাকালে স্থানীয় জনৈক শামসুল হকের ছেলে অপুর নেতৃত্বে ১০/১২ জন সভাকক্ষে ঢুকে প্রধান শিক্ষককে মারধর করার বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে অপু ছাড়া বাকি ১০/১২ জনের নাম কোনো সাক্ষীই প্রকাশ করেন নি।
৪) ২০১৬ সালের ১৩ মে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভা চলাকালে আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় মসজিদ থেকে ঘোষণা প্রদান করা হয় যে ইসলাম ধর্ম আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন শ্যামল কান্তি। কে বা কারা ওই ঘোষণা দিয়েছেন, তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ে কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিরোধের কারণে এমন ঘোষণা দেওয়া হতে পারে বলে বিশ্বাস করার কারণ আছে।
৫) ২০১৬ সালের ১৩ মে বিকেল পাঁচটার দিকে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান প্রধান শিক্ষকের রুমে ঢুকে তাকে গাল-কান জুড়ে দুই হাত দিয়ে পরপর চারটি থাপ্পড় দিয়েছেন এমন দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
৬) সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের নির্দেশে শ্যামল কান্তি ভক্ত কান ধরে উঠবস করতে বাধ্য হয়েছেন তা ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে যে উপস্থিত স্থানীয় জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ সদস্য ওই নির্দেশ দেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন