প্রায় চার বছর আগে বন্ধুকে ডাকাতি মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে তাঁর সঞ্চয়ের ১১ লাখ ৩০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন এক পুলিশ সদস্য ও তাঁর সহযোগীরা। পুলিশ বন্ধুর দ্বারা প্রতারিত হয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ব্যবসায়ী বজলু হোসেন মামলা করলে বিচার বিভাগীয় তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। পুলিশের ওই সদস্যসহ সাতজনকে আদালত তলব করেছেন সম্প্রতি।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে করা মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল টি এম শহিরব প্রতারিত করেন বজলু হোসেনকে। আবার কৌশলে ডাকাতি মামলার আসামিও বানিয়ে দেন। বিচার বিভাগীয় তদন্তে বজলুর অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এ কারণে পুলিশ কনস্টেবল শহিরব, মিরপুর মডেল থানার এসআই ইমরুল ফাহাদ, এএসআই মো. মুক্তার আলী, কনস্টেবল মো. ইকরামুল হক এবং তাঁদের সহযোগী মো. আসিফ, সাদ্দাম ও মেরাজ খান দিপুকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ জারি করা হয়েছে।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বজলু হোসেনের সঙ্গে পুলিশ কনস্টেবল শহিরব সম্পর্ক স্থাপন করে নাটকীয়ভাবে তাঁকে ডাকাতি মামলার আসামি করে ফাঁসিয়ে দেন। অন্যদিকে থানায় আটক রেখে বজলুর স্বজনদের কাছ থেকে দুটি ব্যাংক চেক নিয়ে তাতে বজলুর সই নেন। ওই চেকের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে নিয়ে যান কনস্টেবল শহিরব ও তাঁর সহযোগীরা।
জানা যায়, ঢাকার অটোরিকশা ব্যবসায়ী বজলু হোসেন ও পুলিশ কনস্টেবল শহিরবের বাড়ি ঝালকাঠি। তাঁরা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বজলু একসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। কিন্তু একটি প্রশিক্ষণ চলাকালে তিনি আহত হন। এরপর মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়। পরে তিনি রাজধানীর দক্ষিণখানের ফায়দাবাদে অটোরিকশার ব্যবসা শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অটোরিকশাগুলো বিক্রি করে দেন। ওই অবস্থায় তাঁর মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ফলে তিনি আর বিদেশ যেতে পারেননি। মায়ের চিকিৎসার জন্য তিনি জমি বিক্রি করে আরো কিছু টাকা জোগাড় করেন। ১১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখেন। বন্ধু পুলিশ সদস্যটি সব সময় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সব খবরই জানতেন। ব্যাংকে টাকা আছে এ খবরটি জানার পর পুলিশ কনস্টেবল শহিরব ২০১৫ সালের ২৯ এপ্রিল বিকেলের দিকে বজলু হোসেনকে মিরপুরে একটি বিয়ের দাওয়াত খেতে নিয়ে যান একটি মাইক্রোবাসে করে। শহিরবের সহযোগীরা ওই গাড়িতে ছিলেন। শহিরব একপর্যায়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার কথা বলে উত্তরা র্যাব হেডকোয়ার্টারের সামনে গাড়ি থেকে নেমে যান। অন্যরা মাইক্রোবাসে করে বজলুকে নিয়ে মিরপুর মডেল থানার পেছনে যান। সেখানে হঠাৎ করে মাইক্রোবাসের চালককে তাঁরা মারধর করেন। থানার পেছনের বড় বাগের ৭৬ নম্বর বাড়ির ছাদে বজলুকে ও চালককে নিয়ে যান। সেখানে যান আসিফ, জাহিদ ও অন্য একজন। একটু পরে মিরপুর থানার এসআই ইমরুল ফাহাদ, এএসআই মুক্তার আলী গিয়ে হাজির হন। সবাই মাইক্রোবাসে ওঠেন। মাইক্রোবাসে বজলু, জাহিদ ও চালককে আটক রাখে পুলিশ। পরদিন সকালে বজলু, জাহিদ ও চালককে থানায় নিয়ে ‘ক্রস ফায়ারের’ ভয় দেখানো হয়। এদিকে বন্ধু শহিরব দক্ষিণখানে বজলুর বাসায় গিয়ে বজলুর স্ত্রীকে বলেন, বজলুকে পুলিশ ধরেছে, তাঁকে ক্রস ফায়ারে দেওয়া হবে। টাকা দিলে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা যাবে। বাসায় থাকা নগদ এক লাখ ৩০ হাজার টাকা বজলুর স্ত্রী দিয়ে দেন শহিরবকে। পরে বজলুর স্ত্রীর কাছ থেকে সাউথইস্ট ব্যাংকের দুটি চেক নিয়ে যান মিরপুর থানার এসআই ইমরুল ফাহাদ। চেক দুটিতে পুলিশ কনস্টেবল শহিরবের সহযোগী সাদ্দাম ও আসিফের নামে পাঁচ লাখ করে ১০ লাখ টাকা লিখিয়ে নেন বজলুর কাছ থেকে। ওই টাকা শহিরব ও মিরপুর থানা পুলিশের তিনজন তুলে নেন। কিন্তু বজলুকে না ছেড়ে মিরপুর থানার একটি ডাকাতির প্রস্তুতি মামলার আসামি করে আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মামলায় বলা হয়, বজলু সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের সদস্য। ওই মামলায় কিছুদিন কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেলে আবার তাঁকে আরেকটি চুরির মামলায় জেলগেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব কিছুই করা হয় পুলিশ কনস্টেবল শহিরবের পরিকল্পনায়।
এমনভাবে হয়রানির শিকার হয়ে বজুল হোসেন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। বন্ধু পুলিশ কনস্টেবল শহিরব, মিরপুর থানার তিন পুলিশ সদস্য ও শহিরবের তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে মারধর, বেআইনি আটক, চেকে স্বাক্ষর নিয়ে টাকা উত্তোলন করে তা আত্মসাৎ, নগদ টাকা নেওয়া এবং প্রতারণার অভিযোগে মামলাটি করা হয়। ঘটনাটি তদন্ত করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন আদালত। দীর্ঘদিন তদন্ত করে পিবিআই ২০১৬ সালের ৬ মার্চ প্রতিবেদন দিয়ে ঘটনার সত্যতা পায়নি বলে আদালতকে জানায়। আদালত আসামিদের অব্যাহতি দেন। কিন্তু থেমে থাকেননি বজলু। তিনি মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন করেন। আদালত আবারও তদন্তের নির্দেশ দেন। পরে সিআইডি তদন্ত করে। সিআইডিও আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে। পরে বাদী নারাজি দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। বাদীর দাবি অনুযায়ী আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম তদন্ত করেন। তদন্তে প্রমাণিত হয়, পুলিশ বন্ধু পরিকল্পনা করে বাদী বজলু হোসেনের টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বাদীকে হয়রানি করা হয়েছে।
বজলু হোসেনের করা মামলাটি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩৪-এ বিচারাধীন। আসামিদের আগামী ৬ ডিসেম্বর সশরীরে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এ প্রসঙ্গে বজলু হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশ কনস্টেবল শহিরবের বাড়ি ও আমার বাড়ি একই এলাকায়। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে ওই পুলিশ আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আমাকে ডাকাত সাজিয়ে হয়রানি করেছেন। আবার আমার জীবনের সঞ্চয়ের সব টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আমি হয়রানির শিকার। ডাকাতি মামলা এখনো আমার বিরুদ্ধে চলছে। আমাকে যে মিথ্যাভাবে ফাঁসানো হয়েছে, সম্প্রতি তা আমি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি।’
বজলু হোসেন আরো বলেন, ‘তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি মামলার পেছনে দৌড়াচ্ছি। একদিকে আমার বিরুদ্ধে করা ডাকাতি মামলা, অন্যদিকে আমার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে করা মামলার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি এখন নিঃস্ব।’ তিনি জানান, তাঁর মা ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাঁর চিকিৎসাও করাতে পারছেন না টাকার অভাবে। তিনি এখন বিচার চান। একই সঙ্গে তাঁর টাকাও উদ্ধার চান।
বজলু হোসেন বলেন, ঘটনার পর পুলিশ প্রশাসনকে তাঁর অভিযোগ জানিয়েছিলেন। শুধু অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
উত্তরা ও মিরপুর থানায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, যাঁদের বিরুদ্ধে বজলু হোসেন মামলা করেছিলেন তাঁদের অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। এ কারণে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন