খুনের আসামিকে বিচারিক আদালত মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলে সেটিকে কার্যকর করতে অনুমোদন লাগে হাইকোর্টের; এ অনুমোদনকে বলা হয় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ)।
সারা দেশের কারাগারগুলোতে সাত শ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মৃত্যুভয়ে কনডেম সেলে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না। বরং সময় লাগছে বছরের পর বছর। সেই সাতশ ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে হাইকোর্টে।
হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চ ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল নিষ্পত্তি করছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছর বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর মামলার ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হলেও সাধারণ মামলার ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির হার খুবই কম।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার মফিজ খন্দকার ওরফে ডগু খন্দকার। মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী তার বয়স ৫২ বছর। একটি হত্যা মামলায় প্রাণদণ্ড নিয়ে কারাগারের কনডেম সেলে রয়েছেন ২০১০ সাল থেকে। এ মামলার ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি না হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড-ভয়ে বসে আছেন কনডেম সেলে।
গোপালগঞ্জের কলেজছাত্রী সাদিয়া নুর মিতাকে হত্যার দায়ে বিচারিক আদালত মফিজ খন্দকারসহ তিনজনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। এ মামলাটি ডেথ রেফারেন্সের নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হাইকোর্টে। এর মাঝে গত হয়েছে আট বছর, কিন্তু নিষ্পত্তি হয়নি ডেথ রেফারেন্সের।
বিচারপতি মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এএসএম আবদুল মবিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে চলছে ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি।
এ বেঞ্চের রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মনিরুজ্জামান রুবেল প্রিয়.কমকে জানান, কনডেম সেলে ফাঁসির আসামিরা মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকেন। তারা চান তাদের ডেথ রেফারেন্সগুলো তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করা হোক। হাইকোর্টে সাত থেকে আট বছর সময় লাগে এসব মামলার শুনানি করতে। তার আদালতে ২০১২ সালের ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে।
মনিরুজ্জামান রুবেল আরও জানান, প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে ডেথ রেফারেন্সগুলো সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠানো হয়। বছরের ক্রমিক ধরে এগুলোর পেপার বুক তৈরির পর পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে। এগুলো তৈরিতে অনেক সময় লাগে। কনডেম সেল অমানবিক সেল। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ডেথ রেফারেন্স কনফার্ম করলে সেগুলো কার্যকর করা হয়। আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর।
মনিরুজ্জামান ২০০৮ থেকে এসব মামলা পরিচালনা করে আসছেন। তিনি জানান, মামলার তদন্তের গাফিলতির কারণে দোষি ব্যক্তি ছাড়া পান। আবার নির্দোষ ব্যক্তির সাজা হয়। কারণ নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্টে আসা তদন্তের রিপোর্টগুলোতে অনেক সময় ভুল থেকে যায়। অনেক সময় হত্যার পর মোবাইলের কল লিস্টের মাধ্যমে আসামিকে শনাক্ত করে পুলিশ। কিন্তু সঠিকভাবে আইন অনুসরণ করেন না মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা। অনেক সময় মোবাইল কল লিস্টের সার্টিফায়েড কপি আনেন না তারা। আবার অনেক মামলায় দেখা যায়, আসামির স্বীকারোক্তি ফরম যথাযথভাবে পূরণ করেন না ম্যাজিস্ট্রেট। কিছু কিছু মামলায় কম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে আদালতে আনা হয়।
ডিএজি মনিরুজ্জামান জানান, এসব মামলার পেপার বুক তৈরি করে বিজি প্রেস। এটি তৈরি করতে সময় লাগে অনেক। পেপার বুক তৈরিতে আদালতকে সময় বেঁধে দেওয়ার পরামর্শ দেন মনিরুজ্জামান রুবেল।
বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি শহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জহিরুল হক জহির। তিনি জানান, ২০১১ ও ২০১৩ সালের ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো এই বেঞ্চে বিচারাধীন। শুনানি হচ্ছে। নিষ্পত্তি করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। কারণ আট থেকে ৯ শ পৃষ্ঠা থাকে ডেথ রেফারেন্স মামলায়।
অন্যান্য আপিল মামলা এক থেকে দুই দিনেই শুনানি করে শেষ করা যায়। কিন্তু ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলোর শুনানি শেষ করতে বেশি সময় লাগে। এ জন্য এ মামলাগুলোর রায় দিতেও দেরি হয়। ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানি করার জন্য হাইকোর্টে বেঞ্চ বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন জহিরুল।
হাইকোর্টের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের কারাগারগুলোর কনডেম সেলে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রায় দেড় হাজার কয়েদি। বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে নিম্ন আদালত এসব আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে। আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় অনুমোদনের জন্য জেলা জজ ও দায়রা আদালত থেকে পাঠানো ৭০০টি ডেথ রেফারেন্স এখন হাইকোর্টে, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে মামলার সংখ্যা ছিল ৬৪০টি। গত ৯ মাসে দায়ের হয়েছে ১১৭টি আর নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৭টি।
আদালত সূত্রে জানা যায়, আলোচিত কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলা, রমনা বটমূলে বোমা হামলা, রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যা মামলা, ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরাম হত্যা মামলা, চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রুপাকে গণধর্ষণ ও হত্যা মামলা এবং রংপুরের খাদেম হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও সাজাপ্রাপ্তদের আপিল হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চে শুনানির জন্য রয়েছে।
এমন বিষয়ে কথা হয় সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনজীবীদের সঙ্গে। তারা বলেছেন, ডেথ রেফারেন্স ও আপিল নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত পেপার বুক তৈরিতে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ বেঞ্চ বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষ বিচারপতির সংখ্যাও বাড়াতে হবে।
বিচারিক আদালতে ঢালাওভাবে ফাঁসির আদেশ দেওয়াকে ডেথ রেফারেন্স মামলা জটের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি হাইকোর্টে অনেক বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো শুনানি করতে বেশি করে বেঞ্চ গঠন করা উচিত। কম গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো শুনানির জন্য বেঞ্চ কমানো উচিত।’
একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কনডেম সেলে বসে আছেন। অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। প্রায় ৭০ ভাগ মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত আসামির সাজা কমে হাইকোর্টে। এ জন্য ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো শুনানির জন্য কমপক্ষে আটটি বেঞ্চ গঠন করার পরামর্শ দেন মঞ্জুরুল হক। তার মতে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের দীর্ঘ সময় কনডেম সেলে আটকে রেখে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ মামলাগুলোর বিচার শেষ করতে হবে। যেহেতু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা নির্জন সেল বা কনডেম সেলে থাকে, তারা মৃত্যুর প্রহর গোনে, এ জন্য এ সমস্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত। হাইকোর্টের রায়ে আসামির সাজা কমতে পারে, বাড়তে পারে। হাইকোর্ট তাড়াতাড়ি এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। আসামির অপেক্ষাও শেষ হয়। এ মামলাগুলো রাষ্ট্র তাড়াতাড়ি শেষ করতে না পারলে বিচারপতিরা তাদের সহজাত ক্ষমতাবলে নিষ্পত্তি করতে পারেন। এ রকম নজির দেশে-বিদেশে আছে।’
সারা দেশ থেকে আসা ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলোর পরিসংখ্যান। সূত্র: হাইকোর্ট বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
সুপ্রিম কোর্টের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৪ সালে মোট ডেথ রেফারেন্স মামলা ছিল ৪৩৯টি; এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ১০১টির আর বিচারাধীন ৩৩৮টি। ২০০৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৩-তে; এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৪৯টি, বিচারাধীন ৪৬৪টি। ২০০৬ সালে ৫৭৬টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৬৫টি, বিচারাধীন ৫১১টি। ২০০৭ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৬১৩টি, নিষ্পত্তি হয় ১৪৮টি, বিচারাধীন ৪৬৫টি। ২০০৮ সালে ৬০২টি মামলা থেকে নিষ্পত্তি করা হয় ১২৮টি, বিচারাধীন ৪৭৪টি। ২০০৯ সালে ৫৫৭টি মামলা থেকে নিষ্পত্তি করা হয় ৪৮টি, বিচারাধীন ৫০৯টি। ২০১০ সালে ৫৮৫টি মামলা থেকে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৪৩টি, বিচারাধীন ৫৪২টি।
২০১১ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০৯টি; এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৭৪টি, বিচারাধীন ৫৩৫টি। ২০১২ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৫৯৫টি, নিষ্পত্তি করা হয় ১৪৫টি, বিচারাধীন ৪৫০টি। ২০১৩ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৫১৩টি, নিষ্পত্তি হয় ১১১টি, বিচারাধীন ৪০৬টি। ২০১৪ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৪৯৮টি, এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ১৩৫টি, বিচারাধীন ৩৬৩টি। ২০১৫ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৪৭৭টি, নিষ্পত্তি করা হয় মাত্র ৫৮টি, বিচারাধীন ৪১৯টি। ২০১৬ সালে মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৮০টি, এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৪৫টি, বিচারাধীন ৫৩৫টি। গত বছরে মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০৬টি, এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৬৬টি, বিচারাধীন ৬৪০টি। আর গত ৯ মাসে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁডিয়েছে ৭০০টি।
২০১৭ ও চলতি বছর যে সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, দায়ের হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণে ডেথ রেফারেন্সগুলো নিষ্পত্তিতে সময় লাগছে বেশি। এতে একদিকে যেমন দোষী ব্যক্তির শাস্তি বিলম্বিত হচ্ছে, তেমনি দোষ প্রমাণ না হলে নির্দোষ ব্যক্তিকেও দীর্ঘদিন বিনা বিচারে কারাগারে থাকতে হচ্ছে।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন