রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. মাহবুব আলম। গত ৯ অক্টোবর দুপুরে তার ৬ মাস ১৩ দিন বয়সী শিশুকে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন গাজীপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল হাসপাতালে। সে সময় সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ও শাশুড়ি। ডাক্তার শিশুটিকে দেখে বেশ কিছু টেস্ট (পরীক্ষা) করার পরামর্শ দেন। এরপর ওই হাসপাতালেই টেস্টগুলো করিয়ে নেন মাহবুব হোসেন।
দুপুর ২টার দিকে মাহবুব তার স্ত্রী, সন্তান ও শাশুড়িকে হাসপাতালের নিচ তলায় বসিয়ে টেস্টের রিপোর্ট সংগ্রহ করতে চলে যান। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে এসে দেখেন, তার স্ত্রী, সন্তান ও শাশুড়ি কেউই সেখানে নেই। ফোনেও তাদের পাওয়া যাচ্ছিল না।
পুরো হাসপাতালে স্বজনদের খুঁজে না পেয়ে পরিচিতদের কাছে ফোনে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন মাহবুব। হাসপাতালের নার্স, গার্ড, স্টাফদের কাছে বারবার জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারছিলেন না। হঠাৎ করে কীভাবে তিনজন মানুষ গায়েব হয়ে গেল, এই চিন্তা করতে করতেই কেটে যায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে হাসপাতালে থাকাকালীন মাহবুবকে এক ব্যক্তি জানান, তার স্ত্রী, সন্তান ও শাশুড়িকে খুঁজে পাওয়া গেছে। তারা ওই হাসপাতালের লিফটের মধ্যে আটকে ছিল।
খবর শুনে দৌড়ে লিফটের কাছে চলে যান মাহবুব। ততক্ষণে সবাইকে লিফট থেকে বের করে আনা হয়েছে। নিজের ৬ মাসের শিশুটিকে কোলে নিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন মাহবুরের স্ত্রী। কারণ লিফটে সোয়া ২টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত আটকে ছিলেন তারা।
ঘটনা সম্পর্কে মাহবুব প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমি আমার ছয় মাস বয়সী মেয়েকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম শেখ ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালে। লিফটে ওঠার সময়ে লিফট আমার স্ত্রী, সন্তান ও শাশুড়ি প্রায় আড়াই ঘণ্টা ওই লিফটে আটকে ছিল। আমি সবসময় লিফট অ্যাভয়েড করে চলি, সিঁড়ি দিয়েই বেশির ভাগ সময় ওঠানামা করি। আমি যখন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা তাদের খোঁজাখুঁজি করি। তখন আমাকে একজন জানাল যে, আপনার স্ত্রী ওই লিফটে আটকে আছে। তারা যখন লিফটে আটকা ছিল, তখন হাসপাতালের কেউই সেটা জানত না। তারা তিনজন আটকে ছিল ওই লিফটে। আমার স্ত্রী, আমার বাচ্চা ও আমার শাশুড়ি।’
‘তারা গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে তিন তলায় ওঠার জন্য লিফটে উঠেছিল। তারা দ্বিতীয় তলার কাছাকাছি লিফটে গিয়ে আটকে যায়। দুপুর ২টা ১৫ মিনিট থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তারা লিফটে আটকেছিল। লিফটের ভেতরে যখন তারা কান্নাকাটি করেছে এবং দরজায় বারবার আঘাত করেছে, তখন কেউ একজন সেটা শুনতে পেয়েছে। এরপর ওই ব্যক্তি হাসপাতালের লোকজনদের খবর দিলে তারা গিয়ে তাদের উদ্ধার করে।’
মাহবুব আরও বলেন, ‘এরপর আমি ওই হাসপাতালের ম্যানেজার অ্যাডমিন শুভ্র রয়ের সাথে এই বিষয়ে কথা বলি। তিনি আমাকে জানালেন, তাদের লিফটের ইমারজেন্সি বাটনটি কাজ করে না। সেটি নষ্ট। তাদের লিফটের কোনো অপারেটর নেই। তাদের সেখানে ৮টি লিফট আছে। কিন্তু একটি লিফটের জন্যও কোনো অপারেটর নেই। আমার ৬ মাস ১৩ দিনের বাচ্চাকে নিয়ে তারা কত বেশি ভয় পেয়েছে, সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে আর কিছুক্ষণ আটকে থাকলে তাদের নিশ্চিত কোনো ক্ষতি হতো। আল্লাহর রহমতে তারা এখন বেঁচে আছেন।’
হাসপাতালের লিফটে মাহবুবের পরিবার যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে, এমনটি নতুন নয়। এ ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ।
গত ১৩ অক্টোবর শুভ্রা কর নামের একজন নারী তার ফেসবুকে রাত ১০টা ৫১ মিনিটে একটি পোস্টে লিখেন, ‘সায়েন্স ল্যাব মোড়ে আড়ংয়ের মার্কেটের লিফটে আধ ঘণ্টা ধরে ৫ জন আটকা পড়ে আছি। অনেক জায়গায় ফোন করেও কাজ হচ্ছে না। জেনারেটর নেই। কেউ হেল্প করতে পারেন প্লিজ?’
তার এমন পোস্ট দেওয়ার পরে অনেকে সেখানে কমেন্ট করে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথম পোস্টটি দেওয়ার ৩১ মিনিট পরে তিনি আবারও ফেসবুকে একটি পোস্টে লিখেন, ‘প্রায় ৪৫ মিনিট লিফটে আটকা থাকার পর আমরা বের হইতে পারছি।’
লিফটে আটকা পড়ে ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট। ছবি: সংগৃহীত
এই ঘটনা নিয়ে ওই রাতেই শুভ্রা কিছু ছবিসহ বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আবারও একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। ওই পোস্টটি দেওয়ার পরই তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। লিফট ভীতি ও লিফটের ঝুঁকি নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করতে শুরু করেন সাধারণ মানুষ।
শুভ্রা কর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, ওই রাত সোয়া ৯টার দিকে তিনি তার দুই বন্ধুসহ ধানমন্ডিতে কফি খাওয়ার জন্য সায়েন্স ল্যাব মোড়ের আড়ংয়ের পঞ্চম তলার ‘দুয়ারী’তে যান। সেখানে কফি খেয়ে ১০টার একটু পরেই বেরিয়ে পরেন। তখন তারা তিনজনসহ মোট ৫ জন নিচে নামতে লিফটে ওঠেন। কিন্তু পঞ্চম তলায় লিফটে ওঠার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে যায় এবং লিফটটি চতুর্থ তলা ও তৃতীয় তলার মাঝামাঝি এসে বন্ধ হয়ে যায়।
শুভ্রা কর বলেন, ‘লিফটটি বন্ধ হবার সাথে সাথে আমাদের রিয়েকশন ছিল যে, এখনই জেনারেটর ছাড়া হবে এবং লিফট চলতে শুরু করবে। কিন্তু জেনারেটরের আওয়াজ পাবার পরেও যখন দেখা গেল লিফট চলছে না, তখন আমরা লিফটের ভেতরে স্টিকার লাগানো ইমারজেন্সি সার্ভিসম্যানের নাম্বারে ফোন দেই। প্রথমজনকে ফোন দেওয়ার পর তিনি জানান, তিনি এখন ডিউটিতে নেই এবং দ্বিতীয়জনকে ফোন দিতে বলেন। দ্বিতীয়জনকে ফোন দেওয়ার পর তিনি ‘‘দেখছি’’ বলে ফোন রেখে দেন। এরপর আড়ংয়ের নাম্বারে ও ওখানে গ্রামীণ ইউনিক্লোর নাম্বারে ফোন দেই। কিন্তু তারা কেউ কোনো সদুত্তর দিতে পারে না।’
‘সে সময় লিফটে থাকা অন্য এক ব্যক্তি তার গাড়ির ড্রাইভার ফোন করে ওই বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটিকে ইনফর্ম করতে বলেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না দেখে আমরা ৯৯৯-এ ফোন দেই। সেখান থেকে ফায়ার ব্রিগেডের সঙ্গে কথা বলা হয়। তারা বলেন, তারা দেখছেন কি করা যায়। এরপর আমরা আশা নিয়ে বসে থাকি যে ফায়ার ব্রিগেড যেহেতু কাছেই আছে, দ্রুতই চলে আসবে অথবা অন্য কোনো উপায় হবে এবং শিঘ্রই আমরা মুক্তি পেতে যাচ্ছি। এর মধ্যে ওই ভাইয়া, আপু তাদের ড্রাইভারের সাথে কথা বলেন এবং জানতে পারেন যে, লিফটের সাথে জেনারেটরের কানেকশন নেই। জেনারেটরের সার্ভিস শুধু আড়ংয়ের শো-রুমের ভেতরে আছে। আর যিনি বিল্ডিংয়ের সুপারভাইজার, তিনি লিফটের চাবিসহ যাবতীয় চাবি নিয়ে বাসায় চলে গেছেন, তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ইলেকট্রিসিটি না আসা পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলেও নিচ থেকে জানানো হয়।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শুভ্রা আরও বলেন, ‘আর তখনই আমি ফেসবুকে হেল্প চেয়ে পোস্ট দেই, যদি কেউ কোনোভাবে হেল্প করতে পারেন। কারণ আমার হার্টের সমস্যার কারণে এ রকম সাফোকেশনে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। সে সময় আমাদের সঙ্গেই লিফটে আটকে থাকা শাকিল নামের এক ব্যক্তি ইলেকট্রিক বোর্ডের নাম্বার ম্যানেজ করে সেখানে ফোন দেন। তারা বলে ধানমন্ডি শাখায় ফোন দিতে। কিন্তু ধানমন্ডি শাখায় ফোন করার পর সেখান থেকে আবার বলা হয়, এটা তাদের আওতায় না; আজিমপুর শাখায় ফোন দিতে। আজিমপুর শাখায় ফোন করার পর তারা বলেন, এটা তাদের আওতায় না; জিগাতলা শাখায় ফোন দিতে। ততক্ষণে আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। শাকিল নামের ওই ব্যক্তি বলেন, ‘‘ভাই আমরা একজনের পর একজনকে ফোন করে যাচ্ছি, আর সবাই বলছেন আরেকজনকে ফোন দিতে। কিন্তু কেউ উদ্ধার করছে না, কোনো সমাধান দিচ্ছে না। আমরা আর কতজনকে ফোন করব?’’
নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে শুভ্রা আরও লিখেন, ‘এরপর আমরা জিগাতলা শাখায় ফোন দেই, কিন্তু কেউ ফোন ধরে না। এর মধ্যে আজিমপুর শাখার ব্যক্তি শাকিল ভাইকে ফোন করেন এবং জানতে চান সমাধান হয়েছে কি না। হয়নি শুনে তিনি বলেন, তিনি ব্যাপারটা দেখছেন। আরও ১০ মিনিট সময় লাগতে পারে। আমাদের কাছে তখন ১০ মিনিট মানে অনেক সময়। এর মধ্যে আমাদের ফোন পেয়ে নিচে আমাদের অনেক মানুষ চলে এসেছে। তাদের চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কেউই কিছু করতে পারছিল না। এভাবে আরও ১০/১৫ মিনিট যায়। ততক্ষণে কারো ফোনে চার্জ শেষ, কারো ব্যালেন্স শেষ, নেট শেষ। অবশেষে রাত ১১টায় আজিমপুর শাখার ওই ব্যক্তির বদৌলতে বিদ্যুৎ ফিরে আসে এবং লিফট চালু হয়। আমরা যখন লিফট থেকে বের হই, তখন ফায়ার ব্রিগেড এসে মাত্র পৌঁছায়। ফায়ার ব্রিগেডের ওনাদের কাছে পরিস্থিতি সব খুলে বলার পর ওনারা সিকিউরিটি ইনচার্জকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কেন লিফটের সাথে জেনারেটরের কানেকশন নেই। কেন বিল্ডিংয়ের সকল কর্মী, গ্রাহক চলে যাওয়ার আগেই বিল্ডিংয়ের সুপারভাইজার চাবি নিয়ে বাড়ি চলে গেল? ইত্যাদি।’
লিফটে আটকে থাকা ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে আসেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত
‘ভাগ্য ভালো যে আমাদের মধ্যে কোনো অ্যাজমার প্যাশেন্ট কিংবা বয়স্ক বা শিশু বা গুরুতর অসুস্থ কেউ ছিলেন না। নইলে পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর হতে পারত। একটা এত বড় মার্কেট আর এত...চকচকে শো-রুম, অথচ ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে কোনো ফিডব্যাক নেই, লিফটের সাথে জেনারেটরের কানেকশন নেই! আজকে যেকোনো কিছুই তো ঘটতে পারত! আমরা ধানমন্ডি মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি এই ঘটনায়; জিডি নং ৬৫৫; তারিখ ১৩ অক্টোবর।’
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই যান্ত্রিক ত্রুটি বা অনান্য সমস্যার কারণে চলন্ত লিফট হঠাৎ আটকে যায়। এতে ঘটে যায় নানা দুর্ঘটনা। আর এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটে চলছে।
২০১৬ সালের ২৪ জুন উত্তরার একটি শপিং মলের লিফট ছিঁড়ে পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৫ জন। এরপর হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরও দুজন। সেই আলোচিত ঘটনার পর দেশজুড়ে লিফট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ব্যাপক ভয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকে আবার লিফট ব্যবহার করাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এত কিছুর পরও নানা রকমের অবহেলার কারণে থেমে নেই এই দুর্ঘটনা।
বেসরকারি ভবনের পাশপাশি সরকারি ভবনেগুলোতেও লক্কড়-ঝক্কর লিফট আটকে যায় প্রায়ই। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি লিফট পরিচালনার জন্য একজন লিফট অপারেটর থাকার কথা থাকলেও তা নেই অনেক ভবনে। আবার অনেক ভবনে লিফটের অপারেটররা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন।
মায়ের জন্মদিনে লিফটের চাপায় মৃত্যু
ঘটনাটি ছিল চলতি বছরের ২৯ মার্চে। স্ত্রী উম্মে সালমার জন্মদিন ছিল। তাই সে রাতে স্বামী শিপলুর রহমান তাদের ৯ বছরের ছোট মেয়ে অালভিরাকে নিয়ে বাইরে বেরোচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ছোট করে জন্মদিনটি উদযাপন করা। এ জন্য তারা ১৫ তলার বাসা থেকে নিচে নামার জন্য লিফটে ওঠেন। কিন্তু লিফটের সেন্সর ঠিকমতো কাজ করে না বলে লিফটের ভেতরে প্রবেশ করার সময়ই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। অার সেই দরজার মাঝে চাপা পড়ে ছোট্ট অালভিরা। মুুহূর্তেই তার মাথা ফেটে বেরিয়ে পড়ে রক্ত। এরপর দ্রুত তাকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় স্কয়ার হাসপাতালে। ততক্ষণে মৃত্যু তাকে গ্রাস করে। মায়ের জন্মদিনই হয়েছিল তার মৃত্যু দিবস।
রাজধানীর শান্তিনগর মোড়ে ‘গ্রিন পিস’ নামের একটি ১৮ তলা ভবনে ওই রাত ১০টার দিকে হৃদয়বিদারক এই ঘটনাটি ঘটে।
ঘটনার পরে শামীম রহমান নামের ভবনের এক বাসিন্দা প্রিয়.কমকে জানিয়েছিলেন, ভবনের ১৫ তলায় শিপলুর রহমান ও উম্মে সালমা দম্পতি থাকেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাদের ৯ বছর বয়সী মেয়ে উম্মে আলভিরা রহমানকে নিয়ে বাবা-মা বাইরে বের হচ্ছিলেন। তারা ১৫ তলা থেকে নিচে নামার সময় আলভিরা লিফটের দরজার দুই পাল্লার মাঝে চাপা পড়ে। এতে সে মাথায় গুরুতর আঘাত পায়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মায়ের জন্মদিনে লিফটে আটকে মারা যায় ৯ বছরের শিশু। ছবি: প্রিয়.কম
শামীম নামের ওই ব্যক্তি অভিযোগ করেছিলেন যে, ভবনটির লিফটিতে অনেক দিন ধরেই নানা রকম সমস্যা রয়েছে। সেটা একাধিকবার বলা হলেও কেউ কোনো পদক্ষেপ নেননি।
ভবনের একাধিক বাসিন্দাও একই ধরনের অভিযোগ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, ১৮০টি ফ্ল্যাটের বিশাল তিন ভবনে এক হাজারেরও বেশি মানুষ বাস করে। তিনটি ভবনের জন্য রয়েছে ছয়টি লিফট। তবে সবসময় চালু থাকে একটি। আগে তিনজন লিফটম্যান কাজ করলেও দুর্ঘটনার সময় কাজ করছিলেন একজন। চার হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ হিসেবে মাসে সাত লাখ টাকা সার্ভিস চার্জ উঠলেও মাঝে মাঝে লিফটের বাটন, সেন্সর কাজ না করা, পর্যাপ্ত সিকিউরিটি গার্ড না থাকা, লিফটম্যান এবং গার্ড দিয়ে কমিটির লোকজনদের বাজার করানো নিয়েও ছিল নানা ধরনের অভিযোগ।
এ দুর্ঘটনা সম্পর্কে ওই ভবন পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. আলমগীর মিয়াও বলেছিলেন, ‘আগে থেকেই লিফটির সমস্যা ছিল। এটি একটি দুর্ঘটনা। তবে কেন এভাবে হঠাৎ সেন্সর বন্ধ হয়েছে, সে বিষয়ে লিফট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কারণ জানাতে নোটিশ পাঠানো হবে।’
স্ত্রী-সন্তানকে নিচে নামিয়ে লিফটে আটকে ছিলেন প্রবাসী
চলতি বছরের ৩১ আগস্ট লিফটে আটকে পড়া আবুল কালাম নামের এক যুক্তরাজ্য প্রবাসীকে উদ্ধার করেছিল ফায়ার সার্ভিস। তিনি স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েসহ উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ১৩/বি নম্বর রোডে ‘সিটি হোমস’ নামের একটি আবাসিক হোটেলে উঠেছিলেন। পরের দিন ভোর ৪টার দিকে তিনি বিমানবন্দরে যাওয়ার উদ্দেশে হোটেল থেকে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ লিফটে নিচে নেমে যান। দ্বিতীয় দফায় তিনি লাগেজ নিয়ে উপরে উঠে নিচে নামতে গেলে লিফটে আটকে যান। প্রায় আধা ঘণ্টা হোটেলের ম্যানেজার ও কর্মচারীরা ধাক্কাধাক্কি করে লিফটের দরজা খুলতে ব্যর্থ হয়ে ৯৯৯-এর মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে তাকে উদ্ধার করেন।
এ বিষয়ে উত্তরা ফায়ার স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, ‘৯৯৯’ থেকে তারা খবর পান যে, সিটি হোমস হোটেলের নিচতলায় লিফটের ভেতর এক ব্যক্তি আটকা পড়েছেন। খবর পেয়ে তারা গিয়ে ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করেন।
আটকা পড়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীও
২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বিকেল চারটার দিকে বাংলাদেশ সচিবালয়ে একটি ভবনের লিফটে আটকা পড়েছিলেন। এরপর খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে লিফটের দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, সচিবালয়ের নিজের দফতর থেকে বের হয়ে লিফটে উঠে চারতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত নামতেই তিনি লিফটে আটকে যান। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চেষ্টা করেও মন্ত্রীকে বের করতে পারেননি। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যান। স্বাস্থ্যমন্ত্রী লিফটের ভেতর প্রায় আধ ঘণ্টা আটকা ছিলেন।
হাসপাতালের লিফটেই মৃত্যু হয় রোগীর
২০১৪ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে দেড় ঘণ্টা লিফটে আটকে সুলতানা বেগম (৩৫) নামের এক রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। লিফট আটকে যাওয়ার পরপরই হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ ছিল, যদি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উদ্ধারের ব্যবস্থা করত, তাহলে সুলতানার মৃত্যু হতো না। ওই লিফটে সুলতানাসহ মোট তিনজন আটকা পড়েছিলেন।
হাসপাতালের লক্কড়-ঝক্কর লিফট। ছবি: সংগৃহীত
আর ২০১১ সালের ৯ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের মেডিস্টার জেনারেল হাসপাতালে লিফটের দরজায় মাথা আটকে সাইদুর রহমান (৩৫) নামের এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছিল। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে লিফটের যন্ত্রাংশ খুলে নিহতের লাশ উদ্ধার করে।
নিহত সাইদুর রহমানের বোন আহত সফুরা বেগম ওই সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ঘটনার রাতে ১টার দিকে তিনি ও তার এক বোন অন্তঃসত্ত্বা মনিকে শহরের ডন চেম্বার এলাকার মেডিস্টার জেনারেল হাসপাতাল নামের ওই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ভর্তি করেন। পরে লিফটে তারা দুই বোন ও ভাবী একসাথে ওঠেন। তাদের পরে তার ভাই সাইদুর রহমান লিফটে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু লিফটের দরজা বন্ধ না হয়েই প্রচণ্ড গতিতে উপরের দিকে উঠে যায়। এ সময় লিফটের পাটাতনে তার ভাইয়ের মাথা আটকা পড়ে থেঁতলে যায়। এভাবে এক ঘণ্টা ঝুলে ঘটনাস্থলেই মারা যান সাইদুর রহমান।
যেভাবে চলে লিফট
‘লিফট সার্ভিস বিডি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, লিফট পুরোটা তৈরি হয় স্টিল দিয়ে এবং এটি উঠানামা করাতে একটি বিশাল কপিকল ব্যবহার করা হয়। কপিকলটি কাজ করে একটি ইলেকট্রিক মোটর দিয়ে। সম্পূর্ণ লিফট ঝুলানো থাকে মোটা একটি স্টিলের রশি দিয়ে। অপরদিকে লিফটের ভেতর একটি কম্পিউটার সেন্সর স্থাপিত থাকে। এই সেন্সরই আসলে লিফটের চালিকাশক্তি। লিফট ডাকার জন্য যে বাটন থাকে, তাতে চাপ দিলে সেন্সরে খবর পৌঁছে যায় এবং লিফট বুঝতে পারে যে, তাকে কোন তলা থেকে ডাকা হচ্ছে। তবে সেন্সর অনুযায়ী এর কাজ করার ব্যাপারটা যথেষ্টই জটিল। লিফট ডাকার দুটি বাটন থাকে এবং এ অনুসারে লিফট দুটি পর্যায়ে কাজ করে।
যেভাবে কাজ করে লিফট। ছবি: সংগৃহীত
লিফটে প্রবেশ করার পরপরই দেখা যায় যে, দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এর কারণ হলো, লিফটের দরজাতেও একটি ছোট সেন্সর বসানো থাকে, যেটি বুঝতে পারে দরজার মাঝে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না। যদিও এই সেন্সরটি তেমন শক্তিশালী না। তাই মাঝেমধ্যেই অনেকে লিফটে ঢুকতে দেরি করে দরজাতে ছোটখাটো একটা চাপা খেয়ে থাকেন। লিফটে প্রবেশ করার পর ভেতরে অনেকগুলো বাটন দেখা যায়। লিফটটি যে ভবনে আছে, সেই বিন্ডিংয়ের যতগুলো ফ্লোর, ততগুলো নাম্বার বাটন থাকে। যদি G-তে চাপ দেওয়া হয়, তখন লিফটের সেন্সর সেই নির্দেশনা গ্রহণ করে এবং মোটরকে চালিত করে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছানোর পর সেন্সর বুঝতে পারে যে, গন্তব্যে পৌঁছানো হয়েছে।
ফ্লোর বাটনগুলোর পাশাপাশি লিফটে আরও কিছু বাটন থাকে। এর মধ্যে ফ্যান, স্টপ ছাড়াও অ্যালার্ম লেখা একটি বাটন আছে। কোনো কারণে হঠাৎ লিফট বন্ধ হয়ে গেলে বা কারেন্ট চলে গেলে এই বাটনে চাপ দিলেই নিচে লিফট কন্ট্রোল রুমে খবর পৌঁছে যায় যে, লিফট আটকা পড়েছে। তখন তারা চাবি দিয়ে লিফট খোলার ব্যবস্থা করেন। তাই কখনো লিফটে আটকা পড়লে অযথা আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার না করে অ্যালার্ম বাটন খুঁজে নিয়ে তাতে চাপ দেওয়াই ভালো।
লিফটে আটকে গেলে করণীয়
বিভিন্ন ধরনের ভবনের লিফটের রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ‘লিফট সার্ভিস বিডি’র টেকনিশিয়ান মো. শিমুল প্রিয়.কমকে বলেন, ‘লিফটের ভিতরে আটকে গেলে আতঙ্কিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।’
‘প্রত্যেক লিফটে একটি কল বাটন আছে, যেটা রিসিপশন বা সিকিউরিটি রুমের সঙ্গে সংযুক্ত করা থাকে। যদি অভ্যন্তরীণ সিস্টেমে কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে আপনি খুব দ্রুত সাহায্য পাবেন। আর যদি কল ব্যর্থ হয়, তবে লিফটের দরজায় শব্দ করে নিকটবর্তী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে পারেন।’
লিফটের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে শিমুল আরও বলেন, ‘লিফট নিয়মিত পরিদর্শন করা প্রয়োজন। খেয়াল করা দরকার ভিতরে কিছু ত্রুটি আছে কি না বা সঠিকভাবে কাজ করছে কি না। এ জন্য চুক্তিবদ্ধ লিফট মেরামত কোম্পানির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। লিফটের বাল্ব, সুইচ, ইন্টার কল সেবা এবং বাতাস চলাচল ঠিক আছে কি না, চেক করা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি লিফট নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতার মানুষ বা পণ্যের ওজন বহন করতে পারে। লিফট যাতে কখনোই ওভারলোড না হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।’
‘লিফটের মেশিন রুম সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। লিফটের সেন্সর মেশিন কাজ করছে কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে। রঙের মতো রাসায়নিক পদার্থ লিফটের দরজায় ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন, যাতে লিফটের দরজা ভালোভাবে চলে।’
নিয়মিত লিফটের রক্ষণাবেক্ষণ সেবা পেতে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
ফায়ার সার্ভিসের ভাষ্য
যেকোনো ভবনে লিফটে আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস। এই বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকার উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা ঢাকাসহ বাংলাদেশের যে জায়গাগুলোতে লিফট থাকতে পারে, ওই ধরনের এলাকাগুলো চিহ্নিত করেছি। সেই সব এলাকার ফায়ার সার্ভিসের অফিসারদের আমরা একসাথে ট্রেনিং দিয়েছি। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো লিফটে আটকা পড়েন, তখন আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মাস্টার-কি (চাবি) ব্যবহার করে সেই লিফটি খুলে ফেলতে পারেন।’
‘তবে লক খোলার জন্য আমরা অন্য যন্ত্রের চেয়ে মাস্টার-কি বেশির ভাগ সময়ই ব্যবহার করি। এই কি দিয়ে যেকোনো ধরনের লিফটের দরজা খোলা যায়। এই মাস্টার-কি আমাদের প্রত্যেকটা স্টেশনেই দেওয়া আছে। এ ছাড়াও আমাদের ডোর ব্রেকার আছে, স্টেজার আছে, সেটা দিয়ে লিফটের দরজা ফাঁক করা যায়; আটকে থাকা মানুষদের উদ্ধার করা যায়। আমাদের কর্মীদের এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’
দেবাশীষ বর্ধন আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে পুলিশের কাছে থেকে, থানা থেকে, ৯৯৯-এর মাধ্যমে বা স্থানীয় মাধ্যমে লিফটে আটকে পড়ার খবর আসামাত্রই আমরা উদ্ধারকাজে দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। লিফটের এই দুর্ঘটনা আসলে এখন একটি নিত্য-নৈমিত্তিক দুর্ঘটনা হয়ে উঠেছে। এতে মানুষ অনেক বেশি আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে যায়। অগ্নি দুর্ঘটনার কারণে লিফটে আটকা পড়ার ঘটনা ছাড়াও মেইনটেইন্যান্স সমস্যার কারণে লিফটে আটকা ব্যক্তিদের উদ্ধারে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন