দীর্ঘ ৫৯ বছরের গবেষণার ফসল এক জোড়া বাঁশের সোফা! হরেক গবেষণার ছুঁতায় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের (গবেষক) বিভিন্ন সময় যেতে হয়েছে সূদুর চীন, হংকং, মালয়েশিয়া, ভারত, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশে।
প্রতি বছরই গবেষণায় কোনো না কোনো কর্মকর্তা বিদেশ সফরে যান, নতুন কিছু উদ্ভাবনে গবেষণায় জ্ঞান অর্জনের জন্য। সরকারও প্রতি বছর গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটিকে। তবে এত গবেষণা আর বিদেশ সফরের পরও নেই কোনো উদ্ভাবন। তাই কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই বন গবেষণা ইনস্টিটিউটকে ‘লুটপাট গবেষণা’ ইনস্টিটিউট নাম দিয়েছেন।
জানা গেছে, দেশ বিভাজনের আগে পাকিস্তান সরকার চট্টগ্রামের ষোলশহরে প্রতিষ্ঠা করে দু’পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ এ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট। যার বয়স এখন ৫৯ বছর। দেশ বিভাজনের পর বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কেন্দ্র এ-চট্টগ্রামেই রেখে দেয়।
কিন্তু প্রতি বছরই ইনস্টিটিউটের অবকাঠামো উন্নয়ন, সংস্কার, প্রয়োজনীয় মালামাল ও গবেষণায় প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনা, গবেষণার কাজে বিদেশ সফরসহ নানান ক্ষেত্রে সরকার অর্থ খরচ করে যাচ্ছে। তবে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করেই সরকারের এসব অর্থ আত্মসাৎ লুটপাট চলছে— বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে এমন অভিযোগ করেছেন ওই প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা।
অভিযোগকারীদের মধ্যে একজন বিএফআরআই’র ডুলাহাজারা স্টেশনের ইনচার্জ উত্তম কুমার চৌধুরী।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে তিন পাবর্ত্য জেলায় (বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি) বাশক পাতা চাষ প্রকল্প হাতে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। তবে কোনো সুসংবাদ নেই সেই প্রকল্পে। কোথায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তার অস্তিত্বও মিলেনি পার্বত্য সেই তিন জেলার কোথাও!
অভিযোগে আরো জানা গেছে, আগের অর্থবছরে (২০১৭-২০১৮) গবেষণার জন্য প্ল্যান্ট প্রোপাগেশ ইউনিট (পিপিইউ) তৈরি প্রকল্প নেয়া হয় গাজীপুর শালনা বীজ বাগান ও কক্সবাজার জেলার চকরিয়া ডুলাহাজারা কেন্দ্রে। গবেষণার এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বন মন্ত্রণালয় থেকে ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে প্রকল্পটি কাগজে কলমে বাস্তবায়ন দেখিয়ে পুরো অর্থ তুলে নেয়া হয়েছে তহবিল থেকে।
এছাড়া একই অর্থবছরে (২০১৭-১৮) ৫৬ লাখ ৯১ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে গবেষণা খাতে। এসব টাকা সরকারের কোষাগার থেকে তোলা হলেও আজও গবেষণার কাজ শুরু হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ওই অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিক মজুরি বাবদ সাড়ে তিন লাখ, রাস্তা মেরামতে ৩ লাখ, বাইসাইকেল ক্রয় ১ লাখ ৬৮ হাজার, ডিজিটাল ব্যালেন্স ক্রয় ৪ লাখ, এয়ারকুলার ক্রয় ২ লাখ ৫০ হাজার, কম্পিউটার ক্রয় ৬ লাখ ৪৫ হাজার, রিফ্রিজারেটর ক্রয় ৫০ হাজার টাকাসহ প্রায় কোটি টাকার মালামাল ক্রয়ের বিল-ভাউচার তৈরি করেছেন সেই অর্থবছরের জুন সমাপনীতে। সেসব অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে তোলা হলেও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকসহ চার ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ জানেন না অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে থাকা একাধিক কর্মকর্তা ও বিভিন্ন বীজ বাগানের ইনচার্জরা জানান, ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে বীজ বাগান কেন্দ্রে গবেষণার জন্য যে বীজ দেয়া হয়েছে তা অনেক পুরানো ও ব্যবহার অনুপযোগী। পলিব্যাগ ও পলিথিন ক্রয়ের জন্য কাগজে কলমে কোটেশন টেন্ডার দেখিয়েই বেশ কিছু টাকা লুটপাট করা হয়েছে। অথচ দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে এসব ক্রয় করার সরকারি নিয়ম রয়েছে।
তারা জানান, দুই লাখ টাকার বেশি ব্যয় সংক্রান্ত যে কোনো কাজে দরপত্র আহ্বান করার নিয়ম আছে। সেই জন্য প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকসহ কয়েকজনের একটি চক্র প্রয়োজনে একই কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নামে দেখিয়ে কোটেশনেই ক্রয় দেখাচ্ছেন। তাও কাগজে-কলমে। কেউ কোটেশনের খবর জেনেছেন এবং অংশ নিয়ে মালামাল সরবরাহ করেছেন এমন কোনো নজির নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কার্যালয়ে থাকা সহকারী অরুণ বড়ুয়া বলেন, (দরপত্র আহ্বান) ঝামেলা এড়াতে গিয়ে মালামাল কোটেশনে ক্রয় করি। যেমন আমাদেরকে এয়ারকুলার সরবরাহ করেছে স্মার্ট পাওয়ার এবং পলিথিন সরবরাহ করেছে কৃপা-১। এরা কোটেশন টেন্ডারে অংশ নিয়েই সরবরাহ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে এয়ারকুলার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নগরের আগ্রাবাদ জহুরা মার্কেটের পঞ্চম তলায় অবস্থিত স্মার্ট পাওয়ারের ম্যানেজার আসাদুজ্জামান ও নগরের জুবলী রোডের তিন পোলের মাথায় গোলাম রসুল মার্কেটের দ্বিতীয় তলার কৃপা-১ নামক সেই পলিথিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার জুলের সাথে কথা হয়।
তারা জানান, শুধু বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে নয়, এই পর্যন্ত কোনো কোটেশন টেন্ডারে তারা অংশ নেননি। নগদে তারা দোকান থেকে মামামাল বিক্রি করেন এবং সার্ভিস দেন।
বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয়ে বর্তমানে অবস্থান করছেন ডুলাহাজারা বীজ বাগান কেন্দ্রের ইনচার্জ উত্তম কুমার চৌধুরী। তাকে শাস্তিমূলক বদলী করে প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। কথা হয় সেই উত্তম কুমারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, নষ্ট ও পুরানো বীজ সরবরাহ এবং গবেষণার নামে লুটপাটের প্রতিবাদ করায় সকলের শত্রু হয়েছি। গবেষণার টাকা লুটপাট হবে প্রতিবাদ করা যাবে না।
তিনি বলেন, প্রকল্প পরিচালক হাসিনা মরিয়ম মাঠ সহকারী অরুণ কুমার বড়ুয়াকে দিয়েই এসব করান।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কর্মকর্তা হাসিনা মরিয়ম বলেন, নিয়ম মেনেই সব কাজ করা হচ্ছে। গবেষণা করলেই যে সফলতা আসবে, তাতো নয়।
বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা খুরশিদা আকতার। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় বিগত পাঁচ বছরে গবেষণায় প্রতিষ্ঠানটি কী উদ্ভাবন আছে? বনের নতুন জাত বলতে কী আছে এ প্রতিষ্ঠানে?
এসব প্রশ্নের জবাবে খুরশিদা আকতার কার্যালয়ের এক কোণে থাকা বাঁশ দিয়ে তৈরি এক জোড়া সোফা দেখিয়ে আনন্দের সাথেই জানালেন ‘এটা আমরা গবেষণা করেই তৈরি করেছি’।
এরপর আর কী আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গবেষণা অব্যাহত আছে, আপাতত দৃশ্যমান কিছু আসেনি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন