পাঠাগার বা লাইব্রেরি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘এখানে ভাষা চুপ করে আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। এখানে জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হৃদয় পাশাপাশি একপাড়ায় বাস করিতেছে। বাদ ও প্রতিবাদ এখানে দুই ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকে। সংশয় ও বিশ্বাস, সন্ধান ও আবিষ্কার এখানে দেহে দেহে লগ্ন হইয়া বাস করে। এখানে দীর্ঘপ্রাণ ও স্বল্পপ্রাণ পরম ধৈর্য ও শান্তির সহিত জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেছে, কেউ কাহাকেও উপেক্ষা করিতেছে না।’১৮৯৮ সালে ঢাকা এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে তিনটি দর্শনীয় স্থানের কথা বলেছিলেন, এর মধ্যে ঢাকার প্রথম পাঠাগারটিও একটি।
কিন্তু সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি অনেক শিক্ষিতজনই খুব কমই জানেন ঢাকার প্রথম পাঠাগার কোনটি?
ঢাকার প্রথম পাঠাগারটি অবস্থিত পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলিতে। ‘রাজা রাম মোহন রায় পাঠাগার’ নামেই পরিচিত। তবে কালের যাত্রায় এখন সেই পাঠাগারে নেই কোনো পাঠক। বেকার পড়ে আছে হাজার খানেক বই। নেই তেমন আসবাবপত্র। কেউই ভুলেও পড়তে পাঠাগারে পা বাড়ান না। একটু দেখতে কিংবা পড়তে যান এমন সাধারণ পাঠক এর দেখা মেলা ভার।
সরেজমিনে দেখা যায়, ব্রাহ্ম সমাজের গেট দিয়ে ঢুকতেই একটি জরাজীর্ণ ভবনের সামনে লেখা আছে ‘রাজা রাম মোহন রায় পাঠাগার’। পাঠাগারটির ভাঙ্গা চৌকাঠে লাগানো হয়েছে তালা। নেই তেমন পরিচ্ছন্ন। ভিতরে ঢুকে দেখা গেল যে কয়েকটি আসবাবপত্র আছে তার উপর পড়েছে ধূলাবালির স্তুপ। দেখেই বুঝা যায় অনেক দিন কেউ এ রুমে প্রবেশ করে না কিংবা ধূলাবালি পরিস্কার করা হয় না।
ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে তিনটি ধর্মমত বিকশিত হয়েছিল তার মধ্যে নবীনতমটি হলো ব্রহ্মধর্ম। বাংলায় উদ্ভত নবীনতম ধর্মমত ব্রহ্মধর্মের আদিপুরুষ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। নিজ সমাজকে যাবতীয় কুসংস্কার থেকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে ১৮১৫ সালে রামমোহন গঠন করেছিলেন আত্মীয় সভা নামের একটি সমিতি। ১৮২৮ সালে এই সমিতিকে কেন্দ্র করে গঠন করেন ব্রাহ্মসমাজ। ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনা, ধর্মালোচনা ও সমাজ সংস্কার মূলক কাজের পাশাপাশি একটি পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর ফলে ১৮৭১ সালে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছিল।
এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ঢাকার নাট্য আন্দোলনের অন্যতম সূচনাকারী অভয় চন্দ্র দাস। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন এর নামানুসারে পাঠাগারটি ‘রামমোহন গণ-পাঠাগার’ নামকরণ করা হয়।
১৯১০ সালে প্রায় দশ হাজার টাকা ব্যয়ে সমাজ গৃহের চত্বরে পাঠাগারের জন্য নির্মিত হয়েছিল আলাদা ভবন, যার উদ্বোধন করেছিলেন প্রথম ভরতীয় প্রিভি কাউন্সিলর স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ দত্ত। পাঠাগার ভবনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী। প্রতিষ্ঠা থেকেই বিভিন্ন জনের দানে দুর্লভ-দুষ্প্রাপ্র গ্রন্থের অসাধারণ সংগ্রহশালা ছিল এটি।
কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয় প্রতিষ্ঠার ঠিক একশ বছর পরে ১৯৭১ সালে এই পাঠাগারটি হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে এর আগে এমন পাঠাগার একটিও ছিল না।
বাংলাদেশের প্রথম পাঠাগারের বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সবুজ রায়হান জানান, বই পড়ে জানতে পেরেছি রামমোহন লাইব্রেরি বাংলাদেশে প্রথম পাঠাগার। সেখানে যাওয়া হয়েছে কিনা বা চেনেন কিনা জানতে চাইলে তিনি জানালেন, তিনি সেখানে যাননি কিংবা তেমন ঠিক চেনেন না।
পাঠাগারটি সম্পর্কে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রেজা হাবিব জানেন না বলে জানালেন।
পাঠাগরটির অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়ের তথ্য ও লাইব্রেরি বিষয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ফজলে রাব্বি জানান, এটা পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলিতে অবস্থিত তবে তিনি সেখানো কোনো দিন যান নি।
পাঠাগারটিতে পা রেখেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক গুণীজন।
ব্রাহ্মসমাজের পাঠাগার সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আজিম বকশ বলেন, ‘একসময় ছিল যখন ঢাকা শহরে তেমন বই পাওয়া যেত না। বই ছিল খুবই কম। তখন আমরা দলবেঁধে যেতাম ব্রাহ্ম সমাজের পাঠাগারে পড়তে। তখন ঢাকা শহর বলতে সূত্রাপুর থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত ছিল। এখনকার মতো তেমন লোকজনও ছিল না। তাই আমরা অনেককেই চিনতাম। বিকেলটা সেই পাঠাগারেই কাটিয়ে আসতাম। তবে এখন মনে হয় পাঠাগারটিতে কেউ যায় না।’
তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্রাহ্ম সমাজের গৃহ একসময় ছিল কলরবমুখর এখন তা পরিণত হয়েছে নির্জন এক মন্দিরে।’
পাঠাগার ও ব্রাহ্ম সমাজের সার্বিক অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে তিনপুরুষ থেকে ব্রাহ্ম সমাজের সাথে জড়িত বর্তমান ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল রবি পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি যাতে আগামীতে এই পাঠাগারটিকে আরো সমৃদ্ধ করে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারি। আমরা এর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব।’
পাঠাগারে পাঠক আসার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখন আর আগের মতো এই পাঠাগারে পাঠক পড়তে আসে না। তবে মাঝে মাঝে কিছু শিক্ষার্থী থিসিস করতে কিংবা গবেষক আসেন পড়তে বা দেখতে। তারা আসলে তাৎক্ষণিক পাঠাগারটি খুলে দেয়া হয়। এছাড়া সবসময় বন্ধ থাকে। তবে পাঠাগারটির যথাযথ যত্ন নেয়া হয়।’
বইয়ের সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন প্রায় হাজার খানেক বা এর থেকে একটু বেশি বই আছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন