সাধারণ অর্থে ‘খাট’ শব্দের অর্থ খাটিয়া বা পালন্ক বোঝালেও এই ‘খাটে’র অর্থ একেবারেই ভিন্ন। বেশিরভাগ মানুষ অনুমানই করতে পারবনে না যে, ‘খাট’ কোনো নেশা বা মাদকের নাম হতে পারে!
প্রথম দেখায় অনেকেই এই মাদককে গ্রিন টি মনে করে ভুল করতে পারেন। তবে এটি মোটেও তা নয়। কোনো চা বা সাধারণ পাতার মতো দেখতে হলেও নতুন ধরণের এই মাদকের নাম ‘খাট’।
অনেকে একে আরবের চা বলেও চালিয়ে দেন। ব্যবসার সুবিধার কথা চিন্তা করে নানা দেশে নানা নামে পরিচিত এই ‘খাট’। কোথাও মিরা বা ইথিওপিয়া পাতা নামেও ডাকা হয় এদের। মাদক গ্রহণকারী ও ব্যবসায়ীদের কাছে এই উদ্ভিদটি পরিচিত এনপিএস নামে। এনপিএস হলো- নিউ সাইকোট্রফিক সাবস্টেন্সেস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ায় উৎপন্ন খাট নামে পরিচিত এই পাতা অন্যান্য প্রাণঘাতী মাদকের মতোই ভয়ংকর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাট এমন একটি মাদক যার ভয়াবহতা গাঁজার থেকেও মারাত্মক। যেমন-
* খাট সেবনকারী নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অর্থহীন আবোল-তাবোল কথা বলে।
* যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়।
* মুখে ক্যান্সার হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
* বিভ্রান্ত ও নির্লিপ্ত হয়ে যায়। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে।
* ঘুমের সমস্যা হয়।
* তীব্র মানসিক উদ্বেগ ও আগ্রাসনে আক্রান্ত হয়।
* বার বার চিবানোর ফলে দাঁত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়।
খাট কি
আরবি ‘কাত’ لقات শব্দ থেকে মূলত এর উৎপত্তি। আফ্রিকা ও আরব অঞ্চল খাট উৎপাদনের জন্য ভালো জায়গা। এসব অঞ্চলের অনেকেই এই মাদেক ব্যবহার করেন দিনের পর দিন ধরে। পাতা কেটে রোদে শুকিয়ে চায়ের মতো পান করে নেশায় বুঁদ হতে পছন্দ করে তারা।
কী আছে এতে
খাটে রয়েছে- আলকালয়েড ক্যাথিনোন নামের একটি বিশেষ উদ্দীপক উপাদান। এটি মানবদেহে প্রবেশের পর প্রথমদিকে উদ্দীপনা, ক্ষুধা হ্রাস, এবং উদ্বিগ্নতা দূর করে বা উদাসীন করে।
এর প্রাকৃতিক স্টিমুলেটিং উপাদান মুহূর্তেই সেবনকারীকে চাঙ্গা করে তুলে।
কিন্তু পরবর্তীতে খাট শারীরিক ও মানসিক- দুভাবেই ক্ষতি করে থাকে। এ কারণে গত বছরের মধ্যে ১১০টি দেশ এই খাটকে মাদক হিসেবে চিহ্নিত করে সে সব দেশে আমদানি নিষিদ্ধ করে। জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধ ইউনিটের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসে।
ইতিহাস
আফ্রিকান অঞ্চলগুলোতে অনেকেই এগুলোকে নেশা হিসেবে চিবিয়ে খেয়ে থাকেন। সেখানে এটি একটি সামাজিক রীতি হিসেবেই প্রচলিত আছে বহু বছর ধরে।
দক্ষিণ আমেরিকায় অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে নেশা হিসেবে কোকা পাতা ব্যবহারের ইতিহাস বহু বছর ধরে প্রচলিত। তেমনি খাটও আফ্রিকান অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে কম দামি নেশা দ্রব্য হিসেবে প্রচলিত আছে।
মাদকসেবীরা খাট নামের এই পাতা চিবিয়ে বা পানিতে ফুটিয়ে চায়ের মতো পান করে থাকে।
আন্তর্জাতিকভাবে একে সি ক্যাটাগরির (তৃতীয় শ্রেণির) মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই মাদক মূলত উৎপন্ন হয় আফ্রিকায়। সেখান থেকে রপ্তানি হয় ইউরোপ-আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যসহ অস্ট্রেলিয়ায়।
ডব্লিউএইচও’র ভূমিকা
১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) খাটকে মাদক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করে। মানসিক বিপর্যয় তৈরি করতে পারে, এমন মাদক হিসেবে তারা এটিকে মাদকের তালিকায় স্থান দিয়েছে যদিও, কিন্তু এর আসক্তিকে খুব বেশি গুরুতর সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করছে না।
অন্যান্য দেশে খাটের ব্যবহার
খাট বা কাত বা ইথিওপিয়া পাতা কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু দেশে নিয়ন্ত্রিত পদার্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে জিবুতি, কেনিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এবং ইয়েমেনসহ অন্যান্য দেশে এই পাতা ব্যবহারের বৈধতা আছে।
ইসরায়েলে খাট গাছের পাতা স্বাভাবিক অবস্থায় (কাচা) ব্যবহারের অনুমতি আছে। তবে তা উদ্ভিদ বিরোধী ড্রাগ সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
একসময় ব্রিটেনের শতাধিক ক্যাফেতে এই খাট অবাধে বিক্রি হতো। যার বেশিরভাগ ক্রেতা ছিল সোমালি, ইয়েমেনি ও ইথিওপিয়ান নাগরিকরা। তবে এর ভয়াবহতার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে ২০১৪ সালেই ব্রিটিশ সরকারসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এর আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
তবে ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার মতো কয়েকটি দেশে এখনও রয়েছে খাটের অবাধ ব্যবহার।
জব্দ করা খাট পরীক্ষা করে দেখছেন শুল্ক বিভাগের কর্মীরা
বাংলাদেশে খাট
সম্প্রতি ঢাকায় খাটের কয়েকটি চালান বাজেয়াপ্ত করে শুল্ক বিভাগ। তারপরেই শহর-গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে নতুন এই মাদকের নাম।
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো এলাকাসহ রাজধানীর কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৭শ কেজি খাট জব্দ করা হয়েছে।
এর আগে একটি চালান ইথিওপিয়া থেকে দেশের ২০টি ঠিকানায় ‘গ্রিন টি’ হিসেবে আনা হয়েছিল। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
সর্বশেষ ১০২ কেজি খাটের চালান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গতকাল মঙ্গলবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. সহিদুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তবে তিনি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একে উল্লেখ করেন ইথিওপিয়া পাতা বা খাত নামে।
বাংলাদেশকে এই মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া দেশের গাঁজাসেবীদের মধ্যে ইতিমধ্যে নতুন এই মাদকের প্রতি আগ্রহ জন্মাচ্ছে বলে মনে করছে গোয়েন্দা বিভাগ। তবে দেশের ভেতর এই মাদকের ভোক্তা আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আসাদুল হক খোকন, সংবাদকর্মী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন