অসীম সাহসী আর উদ্যমী ইসমাইল হোসেন ওরফে ন্যান্দা (৬৭)। এখনও ছুটে যান বেওয়ারিশ কিংবা ট্রেনে কাটা টুকরো লাশ বহন করতে। গোলগাল মুখে দাড়ি। বিশাল দেহের অধিকারী ন্যান্দা। এলাকায় `লাশবাহী ন্যান্দা’ নামে পরিচিত।
নীলফামারী পৌরসভা এলাকার কুকাপাড়া (ধনীপাড়া) মহল্লার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন ন্যান্দা। মাত্র তিন শতাংশ জমির ওপরে বসত ভিটা তার।পারিবারিক জীবনে আট সন্তানের জনক। ছয় ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীসহ ১০ সদস্যের পরিবার। অতিকষ্টে মেয়ে দুটোর বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে বিবাহিত, তিনি নিজের সংসার নিয়ে আলাদা। সংসারে সারাবছর অভাব-অনটন লেগেই আছে। তার পরেও ছাড়েননি এই পেশা।
জেলার সৈয়দপুর জিআরপি থানার পুলিশ এবং সদর থানার ওসি, এসআই থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই ন্যান্দা নামের সঙ্গে পরিচিত। সৈয়দপুর রেলস্টেশন থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু হলেই ডাক পড়ে তার। এছাড়াও গলায় ফাঁস, বিষপানে আত্মহত্যা, পুকুরে ডুবে মৃত্যু, কবর থেকে ওঠানো গলিত লাশ বহন করা তার কাছে কঠিন কোনও কাজ নয়। ঘটনাস্থল থেকে ভ্যানে লাশ নিয়ে ছুটে যেতে হয় সদর হাসপাতালের মর্গে।
সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে জেলা শহর থেকে দূর-দূরন্তে, গ্রামে-গঞ্জে রাতের আঁধারে গিয়েও স্বজনদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হয় মৃতদেহ। আবার বেওয়ারিশ লাশ হলে তার দাফনের কাজটিও করতে হয়। বিনিময়ে তার ভাগ্যে জোটে সামান্য কিছু টাকা।
এভাবে এলাকায় দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে লাশ টানছেন ন্যান্দা। জীবন-জীবিকার যুদ্ধে বিচিত্র পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। এ যুদ্ধে কখনও হার মানেননি। ন্যান্দার স্ত্রী রাশেদা বেগম বলেন, ‘প্রথম প্রথম বাড়ির ছেলেমেয়েরা তার ধারে-কাছে যেত না। এমনকি তার কাছে যেতে আমিও ভয় পেতাম। কোনও কোনও সময় স্বজনদের বাড়িতে লাশ পৌঁছে দিয়ে ভোরবেলা বাড়িতে ফিরতো। এখন আর এটা নিয়ে পরিবারের কেউ কিছু বলে না। বরং কাজটি মহৎ ও সেবামূলক বলে মনে করে সবাই।’
ন্যান্দা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন আগে জেলা শহরের চৌরঙ্গীর মোড়ে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল ছিল। সেটি বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের কার্যালয় হয়েছে। ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর থেকেই পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে রিকশা চালাতাম। প্রায়ই হাসপাতালের মূল গেটে রিকশা নিয়ে যাত্রীর জন্য বসে থাকতাম।’
লাশবাহী ভ্যান নিয়ে ন্যান্দা
তিনি বলেন, ‘হঠাৎ একদিন,ওই হাসপাতালে একজন রোগী মারা যায়। লাশটি বহনের জন্য স্বজনরা অনেক অনুরোধ করেও একটি ভ্যান বা রিকশা জোগাড় করতে পারেননি। সেখানে বসে বিষয়টি দেখে খুব ব্যথা পেলাম। পরে বললাম, লাশ নিয়ে আমি যাবো। মানুষ ভয়ে লাশ বহন করতো না। এমনকি সে সময় খুব-একটা রিকশা বা ভ্যানও পাওয়া যেত না।’
‘রোগীর স্বজনদের আহাজারি আর অনুরোধে আমি ওই লাশটি জেলা সদরের কচুকাটা ইউনিয়নের কামারপাড়া এলাকায় তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
এটাই ছিল তার জীবনে প্রথম লাশ বহন করা। ন্যান্দার মতে, এই কাজটি একটি সেবা ও মহৎ পেশা। আজ পর্যন্ত একাধারে লাশ বহনের কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও দুমুঠো ডাল-ভাতের আশায় এই বৃদ্ধকে এখনও লাশ টানতে দেখা যায়।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটি থানায় একটি করে লাশবাহী অটোভ্যান ও চালক নিযুক্ত থাকলে এই সেবাটি সহজে দেওয়া যেত।’
নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, তদন্ত) এরশাদ আলম বলেন, ‘ন্যান্দা আছেন বলে অপমৃত্যুর ও বেওয়ারিশ লাশ দাফন করতে সমস্যা নেই। যেখানে যখন দরকার তাকে ডাক দিলে ভ্যান নিয়ে হাজির। এরপরে ন্যান্দার মতো মানুষ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। এ কাজে তার তেমন চাহিদাও নেই। যে যেমন পারে তাকে খুশি করার চেষ্টা করে। ন্যান্দা একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। লাশ বহনে তার কোনও গড়িমসি নেই।’
এ পর্যন্ত কতগুলো লাশ বহনকরেছেন ন্যান্দা তার হিসাবও রাখেননি। তবে ৩০০ থেকে ৪০০ লাশ হবে বলে তিনি জানান। এ কাজে শুরুর দিকে মনের মাঝে ভয়-ভীতি থাকলেও এখন সবকিছুই স্বাভাবিক বলে মনে হয় তার কাছে।
তিনি আরও জানান, সময়মতো লাশ মর্গে নিতে না পারলে সমস্যায় পড়তে হয় তাকে। আবার চিকিৎসক না থাকায় অনেক সময় মর্গে লাশ রেখে সেখানে খাওয়া-দাওয়াসহ রাতে ঘুমাতে হয়। বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্টে বর্তমানে সাত সদস্যের পরিবারে ছেলেমেয়েদের ভরণ-পোষণ চালাতে হয়। লাশবাহী ভ্যানটিতে শুধু লাশ বহন ছাড়া সাধারণ যাত্রী উঠতে চায় না । কারণ, তিনিও জানেন, এই ভ্যানে সাধারণ যাত্রী ওঠবে না। তাই অনেক সময় অলস হয়ে বসে থাকতে হয়। নতুন রিকশা কেনার সামর্থ্য নেই তার।
অভাব যেন লেগেই আছে তার পেছনে। মাঝে মাঝে লাশ বহনে যে আয় হয়,সেটা দিয়ে কোনও রকমে চলে তার সংসার। তবুও লাশ টানার পেশা ছাড়েননি তিনি।
মাসে কত টাকা আয় হয়— জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষ যখন মারা যায় তখন স্বজনরা হয়ে যায় অসহায়। তাই লাশ বহনে দর কষাকষি না করে মানুষ খুশি করে যা দেয়, সেটা নিয়ে আমিও খুশি থাকি। তবে, এতে দেখা যায় প্রতি মাসে গড়ে আয় হয় আট থেকে ১০ হাজার টাকা। অনেকেই আবার খুশি হয়ে বকশিশও দেয়। এই অর্থ দিয়ে কোনও রকমে চলছে তাদের জীবন।
ন্যান্দার কাছে এটি একটি মহৎপেশা। তিনি বলেন, ‘সব মানুষকে কবরে যেতে হবে।’ এটা ভেবেই আজও লাশ টানছেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন