প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, ১৪ দলীয় জোটের শরিকসহ জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলই নির্বাচনকালীন সরকারে থাকতে চায়। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ আকারে-ইঙ্গিতে এ সরকারে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
তাদের মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ট্রেনে থাকতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারেও দলের প্রতিনিধি থাকতে হবে। কোনো কোনো দল এ সরকারে তাদের একাধিক প্রতিনিধি রাখার দাবিও জানিয়েছে।
যদিও সংবিধানে নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে কিছু নেই। এরপরও একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান যেভাবে সরকার গঠন করে থাকেন, আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেভাবে সরকার গঠন করবেন। সরকারের মন্ত্রিসভায় কাকে রাখবেন, কাকে বাদ দেবেন, এর আকার ছোট না বড় হবে- পুরো বিষয়টি তার এখতিয়ারের মধ্যেই। তবুও জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর নেতারা চান, তাদের নিয়েই গঠিত হোক আগামী দিনের নির্বাচনকালীন সরকার।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারের মধ্যে। তিনি যা ভালো মনে করবেন, সেভাবেই সরকার গঠন করবেন। অতীতেও প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেছিলেন। এবারও চাইলে তিনি তেমনটা করতে পারেন। সংবিধান তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে।’
বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়মমাফিক কাজ পরিচালনার জন্য ২৯ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ওই সরকারে ১৪ দলীয় জোটের বেশ কয়েকজনকে মন্ত্রিসভায় রেখেছিলেন তিনি। পাশাপাশি সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই- এমন একটি দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা করা হয়েছিল। একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনকালীন সরকারও আগের মতোই হবে বলে মনে করেন জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতারা।
বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে থাকা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, জাতীয় পার্টি-জেপি, তরিকত ফেডারেশন- এই চারটি দল বর্তমান দশম জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে। এ ছাড়া আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের আসনে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। দলটির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা। বিরোধী দলে বসেও জাতীয় পার্টি সরকারেরও অংশীদার।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাতীয় পার্টি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাকিদের এখনও বৈঠক হয়নি। তারা বিভিন্নভাবে নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার আগ্রহের কথা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে জানিয়েছেন। বিগত নির্বাচনকালীন সরকারে ছিল না বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। বর্তমান সংসদে তাদের দু’জন সদস্য রয়েছেন। এবার তারা নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী যুগান্তরকে বলেন, ‘১৪ দলীয় জোটের সভায় আমাদের দলের পক্ষ থেকে আমিই প্রথম বলেছি, জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হোক। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তার এখতিয়ার অনুযায়ী সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।’
জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ছয়জন সদস্য রয়েছেন। দলটির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। উনি গত নির্বাচনের সময় যে রূপরেখা অনুযায়ী সরকার গঠন করেছিলেন এবারও সেভাবে করবেন। সোমবার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দু-এক দিনের মধ্যে ১৪ দলের সঙ্গে উনি বসবেন। তখন আমরা আমাদের ভাবনাগুলো তার সঙ্গে বিনিময় করব।’
জাতীয় সংসদে পাঁচটি আসন রয়েছে বিভক্ত জাসদের। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের সঙ্গে আছেন তিন সংসদ সদস্য। এ অংশের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, ‘সরকারদলীয় জোটে তো আমরা আছি। আমাদের দলের সভাপতি বর্তমান সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সে হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন যে সরকার গঠন করবেন সেখানে আমরা থাকব, এটাই প্রত্যাশা। তারপরও প্রধানমন্ত্রী উনার এখতিয়ার অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবেন।’
নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে জাসদের আরেকাংশের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার অনুযায়ী যে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হবে, সেখানে সবার মতামতের ভিত্তিতে আমাদের প্রতিনিধিত্ব রাখতে চাইলে অবশ্যই আমরা থাকব।’
সংসদের দুটি আসনে প্রতিনিধিত্ব করছে জাতীয় পার্টি-জেপি। দলটি মনে করে, নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর। তিনি চাইলে নির্বাচনকালীন সরকারে তারা থাকবেন বলে জানান জেপি মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম।
এ প্রসঙ্গে তিনি যুগান্তরকে আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্টচিত্তে যে সরকার গঠন করবেন, আমরা তাতেই সন্তুষ্ট। আমরা ১৪ দলীয় জোটে ছিলাম না, এবার জোটে আছি। এ সময়কালে আমরা কিছুই চাইনি। জোটভুক্ত দল হিসেবে জোটের নেতৃত্বের প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে, প্রত্যাশাও থাকবে।’
১৪ দলীয় জোটের অধিকাংশ দলের প্রতিনিধিত্ব নেই সংসদে। এ কারণে নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই তাদের সিদ্ধান্ত। ২০১৩ সালে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ছিলেন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (এমএল) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন সে সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন। এ মন্ত্রিসভার আকার ২৫-৩০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই, এমন কেউ মন্ত্রিসভায় স্থান পাচ্ছেন না, এমনটাও বলেছেন তিনি। ওবায়দুল কাদের জানান, এ মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত রূপ দেয়ার আগে জোটের শরিকদের এবং সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে, এমন দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বলেছেন।
এ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি তাদের আরও দু-একজনকে নির্বাচনকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করতে অনুরোধ জানিয়েছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করবেন, এটি তার এখতিয়ার।’
জাতীয় পার্টি সূত্রে জানা গেছে, দলটি নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের আগ্রহের বিষয়টি প্রকাশ করেছে ওই বৈঠকে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, ‘গত নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় আমাদের ছয়জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও একজন উপদেষ্টা ছিলেন। এবার আমাদের সংসদ সদস্যও বেশি। তাই মন্ত্রিসভায় একটু বেশি আশা করতেই পারি।’
সূত্র জানায়, দু-এক দিনের মধ্যে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গেও এ ইস্যুতে কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বৈঠকে নির্বাচনকালীন সরকার, আসন সমঝোতাসহ নানা বিষয়ে কথা হবে। প্রধানমন্ত্রী সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের সঙ্গেও আলোচনা করবেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন