ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে ২০১৫ সালে বিশেষ সুবিধা নিয়েছিল যে ১১টি শিল্পগ্রুপ, এখন তাদের কাছে ব্যাংকের ১৭ হাজার ১০৩ কোটি টাকা আটকা পড়েছে। ওই সময় ১১টি গ্রুপের খেলাপি হওয়া ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকা পুনর্গঠন বা নবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু গ্রুপগুলো কিস্তি না দেওয়ায় সুদে-আসলে তাদের ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, বিশেষ সুবিধা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না। ফলে সুদে-আসলে তা বেড়ে যাচ্ছে। আবার এসব ঋণকে খেলাপিও বলা যাচ্ছে না। কারণ সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ১২ বছর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছে।
বিশেষ সুবিধা নেওয়া ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর অন্যতম হচ্ছে, এননটেক্স গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, কেয়া, রতনপুর, এসএ, বিআর স্পিনিং, রাইজিং গ্রুপ ও আব্দুল মোনেম।
ব্যাংকের এমডিরা জানিয়েছেন, সুবিধা পাওয়ার এক বছর পর ঋণ পরিশোধের সময় এলে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান নানা টালবাহানা শুরু করেছে। তারা পুনর্গঠন করা ঋণে আরও ছাড় চাইছে, আবার নতুন করে আরও ঋণ চাইছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক এসএ গ্রুপ ও নারায়ণগঞ্জের বিআর স্পিনিং টাকাই পরিশোধ করেনি। আবার রতনপুর গ্রুপও পুরো কিস্তি পরিশোধ না করে নতুন করে সুবিধা চেয়েছে। অনেকে আদালতের আশ্রয় নিয়ে খেলাপি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখছেন।
জানা গেছে, এর আগে গত বছরের শুরুর দিকে গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর এসএ, রতনপুর ও এমআর গ্রুপ দুই হাজার ৩১৫ কোটি টাকার পুনঃতফসিল চেয়ে যৌথভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি আবেদন করে। এই তিন গ্রুপের মধ্যে এসএ গ্রুপের পক্ষে ৯২৮ কোটি টাকা পুনর্গঠন করে দেশের ছয়টি ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সর্বোচ্চ ২৯৯ কোটি টাকা পুনর্গঠন হয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে। রতনপুর গ্রুপের পক্ষে তিন ব্যাংকে পুনর্গঠন হয় ৮১২ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬৮৮ কোটি টাকা ছিল জনতা ব্যাংকের। এমআর গ্রুপের বিআর স্পিনিং চার ব্যাংক থেকে ৫৭২ কোটি টাকার পুনর্গঠন সুবিধা নেয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সর্বোচ্চ ৩১৪ কোটি টাকা পুনর্গঠন করে জনতা ব্যাংক। মুসকান ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল, আটা, ময়দা, সুজি, বোতলজাত পানি এবং গোয়ালিনি ব্র্যান্ডের মিল্ক পাউডার ও কনডেন্স মিল্ক উৎপাদন ও সরবরাহকারী চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এসএ গ্রুপ। চট্টগ্রামভিত্তিক স্টিল রি-রোলিং ও শিপ রি-সাইক্লিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রতনপুর গ্রুপ। রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস বা আরএসআরএম স্টিল, মডার্ন স্টিল, জুট স্পিনিং, রতনপুর রিয়েল এস্টেট ও শিপ রিসাইক্লিংসহ বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামস উল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া কয়েকটি গ্রুপ নিয়মিত আছে। কেয়া গ্রুপের কিছুটা বকেয়া আছে। তবে এমআর গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে অপর একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৫ সালে ব্যাংকগুলো নিজেদের ক্ষতি করে ওইসব গ্রুপকে সহায়তা করেছিল। তখন বলা হয়েছিল, বিশেষ সুবিধা নিয়ে শিল্প গ্রুপগুলো ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না।’
প্রসঙ্গত, ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এমন বড় শিল্প গ্রুপগুলোর পক্ষ থেকে খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনে বিশেষ ছাড় দিতে চাপ সৃষ্টি করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে এ সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা দিয়ে একটি নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই নীতিমালার আলোকে ১১ শিল্প গ্রুপকে ১২ বছর মেয়াদে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়।
ওই নীতিমালায় বলা হয়, পুনর্গঠিত ঋণ আর পুনঃতফসিল করা যাবে না। সুবিধা নেওয়া কোনও প্রতিষ্ঠান সময়মতো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সব ধরনের সুবিধা বাতিল হবে। শুধু তাই নয়, নীতিমালার আলোকে পুনর্গঠিত ঋণ পরিশোধে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড পায় ১১টি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া সুদ কমানো, পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো, ডাউনপেমেন্টের শর্ত শিথিলসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয় ওই ১১টি শিল্প গ্রুপকে। এর বাইরে বিদ্যমান পুনর্গঠন নীতিমালার আওতায় ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপকে আরও ১২ হাজার ৬১৭ কোটি টাকার বড় অঙ্কের ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি সাপেক্ষে প্রায় ৩০ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করে। এর বাইরে বিদ্যমান পুনঃতফসিল নীতিমালার আওতায় নিজেরা পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করে প্রায় ৫২ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, এই বছরের মার্চ মাস শেষে ১১ গ্রুপের কাছে ২৪টি ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে এসএ গ্রুপ, এমআর গ্রুপ, কেয়া গ্রুপ ও রতন গ্রুপ খেলাপি হয়ে গেছে। এসএ গ্রুপের ৯২৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে ছয়টি ব্যাংক। অগ্রণী ব্যাংকে এমআর গ্রুপের ১৮৪ কোটি টাকার ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। কেয়া গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৮৮০ কোটি টাকা।
২০১৫ সালে একটি প্রভাবশালী শিল্প গ্রুপ বিশেষ সুবিধায় পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নবায়ন করেছিল। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় ওই প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের এখন সুদে-আসলে পাওনা দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। আরেকটি প্রভাবশালী শিল্প গ্রুপ বিশেষ সুবিধায় এক হাজার ৭৭৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকার ঋণ নবায়ন করেছিল। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানও ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় এখন সুদে-আসলে তা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে। অপর এক গ্রুপ এক হাজার ১৫২ কোটি টাকার ঋণ বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করেছিল। ওই প্রতিষ্ঠানও ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় সুদে-আসলে তা দেড় হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে। এননটেক্স গ্রুপ এক হাজার ৪৯ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। কিন্তু তাদের ঋণও এখন সুদে-আসলে এক হাজার ১৫০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এভাবে ১১টি শিল্প গ্রুপ ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করার পর তা এখন ১৭ হাজার ১০৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এ হিসাব গত মার্চ প্রান্তিকের।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণই আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। এটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।’তার মতে, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করা যেন সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মূল কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ঋণ ফেরত না দিলেও শাস্তি হচ্ছে না। যার ফলে খেলাপি ঋণের সার্বিক পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক নয়।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন