তিন ভাইবোনের পরিবার আমাদের, বাবা সরকারী চাকুরে। অসচ্ছল ছিলাম তা বলা যাবে না তবে উপচে পড়ত না কোনকিছুই। অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে কেন! উপচে পড়ত না কেন? এক্ষণে তাই লিখতেই বসলাম বৈকি।ভয়ংকর কড়া নজরদারিতে বড় হয়েছি আমি, ছোট বলে কখনো সখনও বাবা-মা একটু ছাড় দিতে চাইলেও দুই ভাই ছিল মাথার ওপরে। খাবার জিনিসের ওপর লোভ আমার বড্ড বেশী, প্রিয় নাশতাটা টেবিলে দেখলেই দৌড়ে আগে নিয়ে নিতাম। ‘আহা ছোট’ বলে আম্মা একটু না দেখার ভান করতে চাইলেও দুই ভাই বলে উঠত, ‘আম্মা আম্মা দেখো ও মেহমানদের আগে নিয়ে নিল। ‘
তাতে করে কি শিখেছিলাম জানি না তবে মনে আছে, কোনদিন যদি খাওয়ার সময় শোনা যেত ইস্, আজকে ভাত একটু কম ,তখনই দেখতাম, আম্মার আজকে কেন জানি খিদে লাগছে না, আব্বা এমনিই তাড়াতাড়ি খায় আরো দ্রুত খেয়ে উঠে গেল, বড়ভাইয়ার কাজ আছে এর চেয়ে বেশী খাওয়ার সময় নেই,ছোটুর খেতে ভাল্লাগছে না, ভাত রয়ে গেল আধা বাটি।বড় মাছের টুকরাটা শেষ অবধি বাটিতেই পড়ে থাকে কারণ কেউ নেয়না।সবাই নেয়ার সময় ছোটটাই নেয়, নিজের হাতে অন্যকে বঞ্চিত করে নিজের জন্য ভাল আকাঙ্খা করাটাও যেন পাপ।
একমাত্র প্রাচুর্য ছিল বইয়ে, আব্বা খুব যে বই পড়তেন তা বলতে পারিনা। তবে, তখন ভারতীয় বইয়ের দাম ছিল খুব আর ঘনঘন কাজের সূত্রে আব্বা ভারতে যেত। মনে পড়েনা কখনো কোন বই চেয়ে পাইনি। তাছাড়াও ঘরভর্তি সেবা প্রকাশনী, অনুবাদ আর রুশী বইয়ের একটা ছোটখাট লাইব্রেরী মতন ছিল।আমি কি বই কখন পড়ব তা নির্ধারণ করত আমার ভাইরা, বিশেষ করে বড় ভাইয়া। ‘বড়দের বই’ পড়া শুরু হয়ে গেল আমার বেশ আগেই, তবে কোন কোন বই অবলীলায় বড় ভাইয়া দিয়ে বলত এই দুইটা গল্প ছাড়া বাকিগুলো পড় ।এদুটো আর কটা দিন পরে পড়ো।এখন যা লিখব তাতে অনেকেই বলবেন,’হুহ্ ন্যাকা’।
আমি সত্যি সেগুলো বাদ দিয়েই পড়তাম কারণ আমি জানি, আমি সেটা পড়তে পারব একসময় আর আমাকে বড় ভাইয়া সেইমত জেনেই বইটা হাতে দিয়েছে তাহলে সেই বিশ্বাস ভেঙ্গে যাবেনা? সেতো আমারই অসম্মান।মাসুদ রানা পড়ার অনুমতির অপেক্ষা করতে করতে যেটা হল এত ভাল বই পড়ে ফেললাম মাসুদ রানা আর পড়া হলো না।বিশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি এই দুই জিনিস কিকরে নিজের সম্মানের সাথে জড়িয়ে দিয়ে গেল তারা,এই যাদের কথা বলছিলাম ,সেটা টের পেলাম না। টের পেলাম না তারা দিয়ে যাচ্ছে এক অভিশপ্ত জীবন।
যখন বলি’আমি তো এর বেশী সময় দিতে পারব না’
“তুমি তো আনপ্রফেশনাল’
চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম আমি প্রায় দ্বিখন্ডিত আমার প্রতিশ্রুত সময় দিতে দিতে,প্রফেশনালরা কোথাও নেই।
আচ্ছা শোন দুটো শো, কোনটা কে করবে?
সেকি বাটিতে পড়ে আছে কাটাকুটো, বড় টুকরো তো দূরের কথা।
ছলাকলা, রাগ-অভিমান-সমস্যা দেখিয়ে শাশুড়ীর সঙ্গ ত্যাগ করারও তো দরকার কিন্তু মায়ের জন্য যা করতে চাই তা করতে হলে শাশুড়ী যার মা তার সামনে গিয়ে কি করে দাড়াব?
একি শিখিয়ে গেল পরিবার? একোন অভিশপ্ত জীবন দিয়ে গেল? হায় মনের অজান্তেই ছেলেগুলোকেও তো তাই শেখাচ্ছি,ঠিক না, থালা কেড়ে নিয়ে খেতে শিখতে হবে, তাহলেই এই অভিশাপমুক্তি, সাকসেসফুল লাইফ।
লেখক: সাংবাদিক ও টক-শো সঞ্চালক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন