বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার আর্ল রবার্ট মিলারের নাম ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাষ্ট্রদূত হিসেবে মিলারের যোগদানের আগে এখন শুধুই মার্কিন সিনেটের অনুমোদনের অপেক্ষা। অনুমোদনের পরপরই বর্তমানে বতসোয়ানায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনরত মিলার বাংলাদেশে নিযুক্ত বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের স্থলাভিষিক্ত হবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিলো যুক্তরাষ্ট্র?
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রায় দু বছর আগে, ২০১৬ সালে। রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাধারণ রীতি হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল বদল হলে বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদেরও বদল করা হয়। কিন্তু রিপাবলিক পার্টি ক্ষমতায় আসার পরও ডেমোক্রেটদের দ্বারা বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকে পরিবর্তন করা হয়নি। নির্বাচনের আগের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রাষ্ট্রদূত পরিবর্তন থেকেই প্রমাণিত হয়, বার্নিকাটকে সরিয়ে মিলারকে আনা কোনো রুটিন পরিবর্তন নয়। এর পেছনে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনো পরিকল্পনার সম্ভাবনা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আমরা যদি ইতিহাস পাঠ করি তাহলে দেখব, বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সময় ও অগণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূতদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গুরুত্বপূর্ণ গোপন নথি ফাঁসের জন্য বিখ্যাত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস প্রকাশিত বিভিন্ন নথিপত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকার কথা বারবার উঠে এসেছে। রাষ্ট্রদূতের হঠাৎ পরিবর্তনের পেছনে এমনই কোনো বিষয় কাজ করছে কিনা সে প্রশ্ন উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবসময়ই হস্তক্ষেপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে জড়িত, এর প্রমাণও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী । এই পরাশক্তির বিরোধিতা সত্ত্বেও মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। কিসিঞ্জারের সাবেক স্টাফ অ্যাসিস্ট্যান্ট রজার মরিস এক সাক্ষাৎকারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি কিসিঞ্জারের ঘৃণার কথা স্বীকার করেছেন। মরিস জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করতেন। এর প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডেও মার্কিন দূতাবাসের ভূমিকা আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড টি স্নাইডার পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বার্তা পাঠিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। এই সক্রিয়তা মার্কিন দূতাবাস আগেও একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় দেখিয়েছিল।
স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ও রাজনীতিতে মার্কিন দূতাবাস প্রভাব বিস্তার করেছিল। সে সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মিলারের তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তোলপাড় তোলা ওয়ান ইলেভেনের ঘটনায়ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনার সময় ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া এ বিউটেনিসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাক গলানোর অভিযোগ খুব পুরনো। তিনি ২০০৭ সালের জুন মাসে ঢাকার দায়িত্ব শেষ করে ফিরে গেলে জেমস এফ মরিয়ার্টি রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। তিনিও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেননি বলে অভিযোগ আছে। মরিয়ার্টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর তারবার্তা পাঠান।
এর আগে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের ওপর নজর রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তাঁর সরকারের প্রভাবশালী ১৭ ব্যক্তি সম্পর্কে ২০০৫ সালের ১১ মে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসের ওয়াশিংটনে পাঠানো একটি মূল্যায়ন থেকে। সেখানে বলা হয়েছে, বেগম জিয়া সরকারের ঘনিষ্ঠ এমন প্রভাবশালী ১৭ জনের মধ্যে ১২ জনের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ ছাড়া জামাত নেতা নিজামী মার্কিন সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন বলেও জানা গেছে তারবার্তায়। সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকসই ওই নথিটি ফাঁস করে।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লিখিয়েছে। দিনে দিনে বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। এমন সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র নীরব থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে ভারতের সহযোগিতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ওয়াশিংটন প্রত্যাশা করছে।
নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে এই দুই দেশের নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক রাখা উচিত বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কয়েক বছর আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে এস. জয় শংকরকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগের পেছনে তাঁর যে গুণটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তা হলো, তিনি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। বাংলাদেশেও এবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে যার সঙ্গে ভারতের খুব ভালো সম্পর্ক আছে।
সত্যিকার অর্থে, প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখার ক্ষমতা রাখে, এটি স্বীকৃত। আর মিলার বতসোয়ানায় দায়িত্ব পালনের আগে নয়াদিল্লিতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাঁর জানাশোনা ও প্রভাব বেশ ভালো রকমই আছে। আর নয়াদিল্লির সঙ্গে এই জানাশোনারই অভাব ছিল মার্শা বার্নিকাটের। ভারতের কূটনীতি এখন অনেক শক্তিশালী। এই কূটনীতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছিলেন না বার্নিকাট। আর বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যা চায় তা ভারতের সঙ্গে মিলেমিশেই তাকে নিতে হবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদরা ভালোই বুঝতে পারছেন। তাই হয়তো মিলারকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
ভারতের সঙ্গে একটি ভালো বোঝাপড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার একটি উদ্দেশ্য যে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে আগেই রাষ্ট্রদূত বদলের সিদ্ধান্তে সেটি স্পষ্ট হয়ে গেল।
বাংলা ইনসাইডার
পাঠক মন্তব্য
If you insult an American official , they send in marine. Hannah. faltu article. Joy wants American influence . That is they reason ,army is becoming anti Islam and anti Muslim. New army Chief is the proof.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন