আগামী জাতীয় নির্বাচনের বাকি আরও প্রায় সাত-আট মাস। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত দেশের বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ইস্যুতে বিতর্কও ততো বাড়ছে; বাড়ছে দূরত্বও। এর মধ্যেই এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে নতুন এক ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বলেছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি এমন ব্যক্তিদের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও মার্কিন ভিসা দেওয়া হবে না। এ ঘোষণায় যেন বোমা ফেটেছে। রাজনীতির মাঠ ছাড়িয়ে সেই বোমার পরাঘাত ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র। শুরু হয়েছে তোলপাড়। রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের মুখেই শুধু নয়, দল-মত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের মুখে মুখে গতকাল ছিল বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি নিয়ে আলোচনা। এ ঘোষণার ভালো-মন্দ প্রভাব সম্পর্কে যার-যার মতো চলছে যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণ। শুধু তাই নয়। নড়েচড়ে বসেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পরদিনই আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিরা ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ডাকে তার বাসায় হাজির হন। সেখানে তারা রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেন। বলাবাহুল্য, এ বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল- অবাধ, সুষ্ঠূ ও শান্তিপূর্ণভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা। সেখানে নেতারা তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন ভিসানীতিকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফে আশা করা হয়েছে, এ নীতি যথেচ্ছভাবে প্রয়োগের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে যেন অনুসরণ করা হয়।
advertisement
নতুন ভিসানীতি নিয়ে গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় বৈঠকটি শুরু হয়ে শেষ হয় বেলা পৌনে ২টায়। পরে বৈঠকের ব্যাপারে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এক বার্তায় বলেন, আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এমন ব্যক্তিদের ভিসা সীমিত করার এই নতুন ভিসা নীতি সবার জন্য প্রযোজ্য। বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, মো. এ আরাফাত, বিএনপি নেতাদের মধ্যে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, জাতীয় পার্টি নেতাদের মধ্যে দলটির মহাসচিব অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত
ভিসানীতি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, আওয়ামী লীগ-বিএনপির অবস্থান, রাজনৈতিক সংলাপের সম্ভাব্যতা এবং মার্কিন দূতাবাসের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যে খুবই গঠনমূলক ও ইতিবাচকভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি স্পষ্ঠ করা হয়। সূত্র জানায়, বৈঠকে ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় ঘটা জ¦ালাও-পোড়াও নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে মৃদু বাহাস হয়। মার্কিন দূত সংলাপ নিয়ে মনোভাব জানতে চাইলে দলগুলোর নেতারা দলীয় অবস্থান অনুযায়ী নানান দিক নিয়ে কথা বলেন। রাষ্ট্রদূতের তরফে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্র সংলাপে ভূমিকা রাখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র যে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সরকার, বিরোধীদল দল ও নাগরিক সমাজের সবার প্রচেষ্টার অংশীদার হতে চায় সে বার্তাও দেয়া হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, নূন্যতম কি পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে- এ প্রসঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধিরা জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেও নির্বাচনকালীন সরকার অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। তাহলেই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা জানান, সংবিধান অনুযায়ী সরকার ও আওয়ামী লীগ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। সেটি শুধু কথার কথা নয়, আমরা করে দেখাব। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে বাধা ও সহিংসতা চায় না, আমরাও চাই না। আওয়ামী লীগের তরফে স্পষ্ট করা হয়, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বৈঠক শেষে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক এম এ আরাফাত বলেন, নতুন ভিসানীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমাদের বলেছেন, এই ভিসা নীতি কোনও দল, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নয়। যারাই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দেবে এবং সহিংসতা করবে, তাদের বিরুদ্ধে এটি কার্যকর হবে। এম এ আরাফাত আরও বলেন, বিএনপি নেতারা তাদের চিরাচরিত অভিযোগগুলো করেছেন। তারা জ্বালাও-পোড়াও করেননি বলেও দাবি করেছেন। আরও বলেছেন, দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। সরকার তাদের ডিস্টার্ব করছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারা জিতবে।
বিএনপির উত্থাপিত অভিযোগগুলোর জবাব আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ভিসানীতির ওপর আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি। বৈঠকে টকশোর মতো বিতর্ক তৈরি করতে চাইনি। আমরা আমাদের কথা বলেছি; বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তাদের কথা বলেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত সবার কথা শুনেছেন। পরে বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে পারবে, সবকিছু তো সম্ভব নয়।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই ভিসা নীতি ক্ষমতাসীনদের ভোট কারচুপির বিরুদ্ধে বড় ধরনের ‘সিগন্যাল’। কেন এ নীতিকে বিএনপি স্বাগত জানাচ্ছে, তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত এসেছে। আমরা এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি এ জন্য যে, নির্বাচন নিয়ে এ মুহূর্তে দেশের মানুষের যে শঙ্কা-দ্বিধা রয়েছে, তা কাটাতে এ ধরনের পদক্ষেপ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
রাষ্ট্রদূতের বাসার বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, মার্কিন নতুন ভিসা নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হোক। তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমাদের দলও একমত।
ভালো নির্বাচন পাবো বলা যাচ্ছে না: ইমতিয়াজ আহমেদ
নতুন ভিসানীতির প্রভাব সম্পর্কে বিশিষ্ট বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, গণতন্ত্রে যে নির্বাচন, কোন সহিংসতা ছাড়া সাবই মিলে ভোট দেওয়া-সেই ধরনের নির্বাচন করতে হলে ন্যূনতম যেসব শর্ত প্রয়োজন, তার মধ্যে অন্যতম হলো, বড় দলগুলোর পরস্পরের প্রতি আস্থা যেন থাকে। কিন্তু আমাদের দেশেন রাজনীতিতে বড় বিভাজন হয়ে আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- মার্কিন এই ভিসানীতি দুদলের মধ্যে আস্থা বাড়াবে নাকি বিভাজন আরও বাড়াবে? আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, মনে হচ্ছে বিভাজনটা আরও বাড়ল। কারন সরকারি দল এর একরকম ব্যাখ্যা দেবে, বিরোধী দল দেবে অন্যরকম।
ড. ইমতিয়াজ বলেন, নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রে যে ঘাটতি রয়েছে, সেটি পূরণে কতটা সহায়ক হতে পারে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটা এখনই নয়, আরও পরে বোঝা যাবে। ভিসানীতির পরিবর্তনে ভালো নির্বাচন পাওয়া যাবে, সেটা আপাতত বলা যাচ্ছে না। উপরন্তু এ নীতি ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশকে ছোট করা হয়েছে। এ ঘোষণাটা আমাদের জন্য নেতিবাচক। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এ ঘোষণার কারণে অনেক দেশের বিনিয়োগকারী বিশেষ করে পশ্চিমারা এদেশে বিনিয়োগে উ’সাহ হারাবেন। অন্য দেশগুলো মার্কিন এই ভিসানীতি ঘোষণার বিষয়টিকে কিভাবে বিবেচনা করবে- সেটিও দেখার বিষয়।
ড. ইমতিয়াজ বলেন, এ ভিসানীতি ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবই ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে বড় ধরনের চিন্তায় পড়বে বলে আমি মনে করি না।
নতুন ভিসানীতি সংলাপেরই আভাস- এম হুমায়ুন কবীর
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ৫২ বছরের ইতিহাসে আমরা কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি। সেই বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এমন একটা উদ্যোগকে ইউনিক বলা যায়। দেশটি চেষ্টা করছে একটা সংলাপের জন্য প্রেসার দেওয়ার। এই প্রেসারটা ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরাসরি না দিয়ে কৌশলে দিয়েছে।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কার কার ওপর অবরোধ আরোপ করা আছে যুক্তরাষ্ট্রের, তা আমরা জানি। কিন্তু নতুন নীতিটি যে কারো উপর প্রয়োগ করা সম্ভব। যাকে সন্দেহ হবে, তার ওপরই প্রয়োগ করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের বার্তা খুবই শক্তিশালী। বাইডেন প্রশাসনের নীতিগত অবস্থানের প্রতিফলন এ নীতি। তিনি বলেন, কেউ যদি একটা কাজ করে সেটা যদি গ্রহনযোগ্য না হয় তাহলে সে এটার আওতায় পড়বে। না করলে নয়। গনতন্ত্রের জন্য, বৈষম্য রোধ করার জন্যই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। মানুষের অধিকারের জন্যই আমরা সংগ্রাম করেছি। এটা তো আমাদেরই করা উচিত। আরেক দেশের কেন বলে দিতে হবে?
এ নীতি দিয়ে নির্বাচনের গুণগত পরিবর্তন করা যাবে না -শান্তনু মজুমদার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেছেন, বর্তমান বৈশি^ক বাস্তবতায় এটা খুব শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হবে না। অতীতে হয়তো হয়েছে। এখন এ অস্ত্র প্রয়োগে খুব বেশি কাজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনের গুনগত পরিবর্তন করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন