এ দেশের সমাজে একটা কথা বহুল প্রচলিত- সুন্দর মানেই গায়ের রঙ ফর্সা। যার গায়ের রঙ শ্যামলা কিংবা কালো সে আর যা হোক সুন্দর না।
‘আমার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল শুধু আমার গায়ের রঙ কালো এই কারণে। আমার বাবা-মা পাত্রপক্ষের কাছে আমার অজান্তে যে ছবি পাঠিয়েছিলেন সেখানে আমাকে ফর্সা হিসেবে দেখানো হয়েছিল। পাত্রপক্ষ যখন দেখল আমার গায়ের রঙ শ্যামলা ধাচের তারা একরকমের জানিয়ে দিল, কালো মেয়ের কাছে ছেলের বিয়ে দেবে না'- নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এমনটাই বলছিলেন উন্নয়নকর্মী হাবিবা জান্নাত।
হাবিবার মতো এমন অনেক মেয়ে আছে যারা নিজেদের গায়ের রঙ নিয়ে এক রকমের হীনমন্যতায় ভোগেন। ছোটবেলা থেকে তারা কালো ও অসুন্দর এমন সব তকমা সহ্য করে বড় হন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবার, প্রতিবেশী ও আশপাশের বন্ধুমহল থেকে শোনা কথার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় জড়তা। এই জড়তার ফলে তারা ভেবেই নেয় সুন্দর মানে ফর্সা। তাই ফর্সা হওয়ার জন্য যা যা করার দরকার তাই করে তারা।
এটি অস্বীকার করা সুযোগ নেয় যে, সৌন্দর্য শিল্পেও (Beauty industry), অন্যান্য অনেক শিল্পের মতো, রয়েছে পদ্ধতিগত বর্ণবাদ এবং বৈষম্যের দীর্ঘ ইতিহাস। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপ কেন্দ্রিক সৌন্দর্যের মানদণ্ডের প্রতি পক্ষপাত। তাছাড়া রয়েছে মাটির রঙের মানুষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং তাদের প্রতি অবজ্ঞা। এই সমস্যাগুলো দীর্ঘদিন ধরে গভীরভাবে জমে আছে সমাজে এবং এসব কাটিয়ে উঠতে সব শ্রেণির মানুষের উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশ কিংবা পার্শ্ববর্তী ভারতে যাদের ফর্সা বলা হয় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তারা একরকমের বাদামী রঙের মানুষ। মূলত পশ্চিমে সাদা (হোয়াইট), আফ্রিকায় কালো (ব্ল্যাক) ও এশিয়া কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার বেশকিছু দেশের মানুষদের বাদামী (ব্রাউন) হিসেবে ধরা হয়।
বহুদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশে পশ্চিমাদের উপনিবেশ থাকার কারণে সেখানে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে- যারা ফর্সা তারাই সুন্দর। প্রভু কিংবা শাসককে সর্বেসর্বা ভাবার জায়গা থেকে এই মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ কিংবা ভারতের মতো দেশে এই মনোভাবকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের প্রসাধনীকেন্দ্রিক ব্যবসা। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির মতো ক্রিমের যখন কয়েক যুগ ধরে মূল কথাই ছিল কালো ত্বক ফর্সা করা হয় কিংবা বড় বড় বিউটি পার্লারগুলো যখন রাখঢাক ছাড়াই 'হোয়াইট সুপ্রিমেসি' এর গুণ গায় তখন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি পোস্ট কলোনিয়াল সমাজ ও সেই সমাজের বিজ্ঞাপনের ধরনই ঠিক করে দিচ্ছে সৌন্দর্য মানে কী!
এ বিষয়ে সময় সংবাদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ এহসান হাবিবের। তিনি বলেন, মূলত মিডিয়া ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাংস্কৃতিক চর্চা এ ধরনের মনোভাব বিস্তারের জন্য দায়ী। এশিয়ার দেশগুলো ব্রিটিশ কলোনি থাকা অবস্থায় এ কথা বারবার বুলির মতো মুখস্ত করানো হয়েছে, ফর্সা মানে সুন্দর, সাদা চামড়া মানে আধিপত্যের প্রতীক। এরপর বি-উপনিবেশীকরণের মধ্য দিয়ে দেশগুলো মুক্ত হলেও তাদের মগজে রয়ে গেছে কলোনিয়াল সেসব ভাবধারা। দেশের মিডিয়া, বিজ্ঞাপন সংস্থা, চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা সবকিছুই যখন পশ্চিমা সাদা চামড়াদের দিয়ে প্রভাবিত তখন আপনা থেকেই সাদাদের আধিপত্যের জায়গাটি একটি শক্ত ভিত তৈরি করে।
বি-উপনিবেশের পরেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাদা চামড়ার আধিপত্যের ব্যাপারে এহসান হাবিব বলেন, ‘প্রথমত আমাদের অঞ্চলগুলোতে সৌন্দর্য মানে যে সাদা না এ নিয়ে বড় কোনো কাজ হয়নি কিংবা হয়ে থাকলেও আমরা তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। অন্যদিকে আমাদের মিডিয়া ও চলচ্চিত্র পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অনেক বেশি প্রভাবিত। পার্শ্ববর্তী দেশের সিনেমা জগত অর্থাৎ বলিউড আবার ব্যাপকভাবে হলিউড থেকে প্রভাবিত। এতে করে নেটওয়ার্কিংয়ের জায়গায় আমরা দিনশেষে সাদা চামড়ার মানুষের দেখানো পথ ধরেই চলছি, যেখানে নিজেদের পরিচয়কে বিশ্বমানের করার ব্যাপারে থেকে যাচ্ছে বড় রকমের একটি ঘাটতি।’
দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যাদের গায়ের রঙ কালো তারা ছোট বেলা থেকেই নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার, পাশাপাশি ক্ষেত্র বিশেষে শুনতে হয়েছে নানা ধরনের কটূক্তি। এক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীরা বেশি ভুক্তভোগী ও ছোটবেলা থেকে তাদের এমন এক পরিবেশের মাধ্যমে বড় করা হয়েছে যেখানে ফর্সা না হওয়াটা একটি আজন্ম দোষ হিসেবে শিকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী সময় সংবাদকে বলেন, ‘‘আমি জন্মের পর এক মাস আমার দাদা-দাদি আমাকে দেখতে আসেননি। তাদের প্রথম আক্ষেপ ছিল নাতি না হয়ে নাতনি জন্ম নেয়া ও এর থেকেও বড় আক্ষেপ ছিল নাতনির গায়ের রঙ কালো হওয়া। কালো হওয়ার জন্য আমার সবথেকে বেশি শুনতে হয়েছে, 'ভালো জামাই পাব না, বিয়ে হবে না' এমন সব শ্লেষ্মাত্মক কথা।’’
সনাতন সম্প্রদায়ের শ্রীকৃষ্ণকে যখন শ্যাম বর্ণ হওয়ার পরেও বলিউডের ছবিতে ফর্সা এক পুরুষ হিসেবে দেখানো হয় কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে জন্ম নেয়া যিশুকে যখন পশ্চিমাদের মতো ফর্সা চেহারার একজন মানুষ হিসেবে সাজানো হয়, তখন সহজেই অনুমেয় তথাকথিত বর্ণবাদ দূর হলেও কিংবা বর্ণবাদের বিরুদ্ধ্বে কথা বললেও বিশ্বের অনেক মানুষ বিশেষ করে বাদামী হয়েও দক্ষিণ এশিয়ার মানুষেরা এক ধরনের সাদা চামড়ার আধিপত্যে ভোগেন। মূলত ফর্সা হওয়াকে যখন সৌন্দর্যের মাপকাঠি ধরা হয়, ক্রিম মেখে তিন সপ্তাহে ফর্সা হওয়ার চ্যালেঞ্জকে যখন ত্রাতা হিসেবে নেয় এদেশের মানুষ তখন আমাদের প্রগতিশীল হওয়ার জন্য আরও অনেক দূর হাঁটতে হবে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট সমাজবিজ্ঞানীরা।’
কৃষ্ণকলি গানের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ যখন কালোকে ভালো বলে দেখাতে চেয়েছেন, সেখানে কালো কতটা সুন্দর তার থেকেও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কালো কতটা মার্জিনালাইজড। দেশের বিউটি পার্লার কিংবা ক্রিমের বিজ্ঞাপনগুলো এখনো মনে করিয়ে দেয় কালো হয়ে এদেশে জন্ম নেয়া দোষের এবং এ দোষ ঢাকতে যেভাবেই হোক ফর্সা সাজার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। অথচ শুধু বাহ্যিকভাবে বিবেচনা করলেও গায়ের রঙ যে সৌন্দর্যের মাপকাঠি নয়, বরং শরীরের গঠন ও আরও অনেক দিক মুখ্য সে ব্যাপারে একটি সিংহভাগ জনগোষ্ঠী এখনও অজ্ঞতার ভেতরে বাস করে। এই অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই করপোরেট অনেক প্রতিষ্ঠান দিনকে দিন মানুষকে পণ্য বানাচ্ছে, যা প্রতিনিয়ত দিচ্ছে ভুল বার্তা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন