বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের গত দেড় মাস ধরে আরকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি চলছে। ওই লড়াইয়ের কারণে সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসকারী লোকজন মাঝে অজানা আতংক দেখা দিয়েছে।
তুমব্রু-ঘুমধুম ছাড়াও সপ্তাহজুড়ে উখিয়ার সীমান্তবর্তী পালংখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টের ওপারে গোলাগুলি চলছে বলে স্হানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের নতুন ফাঁদ হিসেবে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বলে অনেক রোহিঙ্গারা এ প্রতিনিধিকে জানান।
উখিয়ার জামতলী ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা সলিম উল্লাহ বলেন, মিয়ানমার সরকার চায় না রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজ জন্মভুমিতে ফিরে যাক। বর্তমানে সৃষ্টি হওয়া সংঘাত সেটি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এক ধরনের নাটক। আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজন সেদেশের রাখাইন রাজ্যে রয়েছে। তাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম, আরকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে বলেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে। আর না হলে তাদের ওপর হামলা চালানো হবে।
উখিয়ার থাইংখালি ১৪ নম্বর ক্যাম্পের নুরুল আলম বলেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী দমন, পীড়ন ও নিয়ার্তন চালায়, এরপর জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি-জায়গা জমি ছেড়ে অনেক আত্মীয় স্বজনকে হারিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। এই হত্যাযজ্ঞ ও নিযার্তনের ঘটনায় আন্তজার্তিক আদালতে বিচারকার্য ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে মিয়ানমার জান্তা সরকারের নতুন কৌশল বলে দাবি করেন।
তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন সংবাদ ও তথ্যে তারা জানতে পারেন, রাখাইন রাজ্য বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নতুন করে সেখান থেকে বিতাড়িত করার জন্য নতুন যড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে।
অন্যদিকে তুমব্রু কোনার পাড়া সংলগ্ন শূন্যরেখায় বসবাস্কারী কিছু সংখ্যাক রোহিঙ্গা উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। তুমব্রু শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গা মোহাম্মদ সাদেক মিয়া বলেন, মিয়ানমারের ওপারে প্রতিদিন গোলা গুলি চলছে। রাত হলে আতংক। সে কারণে কিছু কিছু রোহিঙ্গা তাদের আত্নীয় স্বজনের কাছে চলে যাচ্ছে। তবে, কয়জন গিয়েছেন সে ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি সাদেক মিয়া। অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সীমান্তরক্ষী বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে যাত্রীবাহী গাড়িতে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে।
শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দেড়টার দিকে তুমব্রু থেকে একটি ইজি বাইক উখিয়ার বালুখালীর দিকে যাচ্ছিল। এসময় বিজিবি সদস্যরা গাড়ি তল্লাশি করার সময় ওই গাড়িতে থাকা পাঁচ রোহিঙ্গা দৌড়ে পালিয়ে যায়।
বিজিবির এক সদস্য বলেন, এরা উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যাচ্ছে। সে কারণে সীমান্তে মোড়ে মোড়ে চৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু ও উখিয়ার পালংখালী সীমান্ত এলাকায় গত দেড় মাস ধরে চলমান বিমান হামলা ও মর্টার শেল ও ভারী অস্ত্রের বিস্ফোরণের পর আবারো শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত বিমান থেকে গোলা ছোড়া হয়েছে। এ ঘটনায় সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ ফের আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
সীমান্তঘেঁষা তুমব্রু পশ্চিম পাড়া বাসিন্দা আব্দুল জব্বার (৩৫) এর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ঘুমধুম-তুমব্রু এলাকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজ ও টমটম (ইজিবাইক) সিএনজি গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। সীমান্ত এলাকায় দেড় মাস যাবত চলমান মর্টার শেল ও হেলিকপ্টার এবং যুদ্ধ বিমান থেকে ছোড়া গোলা ও ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দে কাজ করা তো দূরের কথা আতঙ্কিত হয়ে মনে হয় যেন এক যুদ্ধের ময়দানে রয়েছি।
তিনি বলেন, বিগত সময় মর্টার শেলের গোলা ও ভারী অস্ত্রের গুলি তাদের এলাকায় পড়েছে। ছেলেমেয়েরা ভয়ে স্কুলে যেতে পারে না। এদিকে এই সংঘাতের কারণে ঘুমধুম-তুমব্রু এলাকায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে তুমব্রু সীমান্তের কাছাকাছি মংডু থানার ঢেকিইবনিয়া, মেদায়, সাম্বালাসহ বেশ কিছু গ্রামে ড্রোন ব্যবহার করে বিমান হামলা চালানো হয়েছে এবং সীমান্তের ওপারে মাইন বসিয়ে রাখা হয়েছে।
পালংখালী ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জাফরুল ইসলাম বাবুল (৪৫) বলেন, শুক্রবার রাত আনুমানিক ১১টার দিকে পালংখালী সীমান্তের কাছাকাছি ওপারে দফায় দফায় মর্টার শেলের শব্দ শোনা গেছে। এরপর দেখা যায় আগুন জ্বলতে। গভীর রাত পযর্ন্ত এই গোলার শব্দ শোনা গেছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরকান আর্মির মধ্যেই চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢুকতে পারে।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, উখিয়া-টেকনাফে ১২ লাখের অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই জনগোষ্ঠী চাপ তাদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে মিয়ানমার জান্তা সরকারের একের পর এক হামলার ঘটনায় সীমান্ত এলাকার মানুষ আতংকিত। এ হামলা বন্ধ না হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হবে এবং নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন