দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (তিতাস)। এর বিতরণ এলাকায় আবাসিক ও শিল্প খাতে লাখ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে যতই অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে, ততই মানুষের মধ্যে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। দিন যত যাচ্ছে, অবৈধ ব্যবহারকারীদের সংখ্যা তত বাড়ছে।
গত এক দশক এ প্রবণতা যে হারে বাড়ছে, তাতে উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় আশার আলো দেখছেন না কর্মকর্তারা। তবে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ মোল্লা বলেছেন, অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীদের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনবেন।
advertisement
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিতাসের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মনে করেন, শহরের পর শহর মানুষের মধ্যে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেওয়ার প্রবণতা যে হারে বাড়ছে, তাতে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীদের দমিয়ে
রাখা অনেক কঠিন। ওই কর্মকর্তারা মনে করেন, বিশেষ করে আবাসিক খাতে গ্যাস ব্যবহার বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। নতুন নতুন এলাকায় নতুন ভবনে প্রতিনিয়ত অবৈধ সংযোগ নিচ্ছে মানুষ। তিতাসের কর্মকর্তাদের দাবি, লোকবল সংকট এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সব অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না।
ওই কর্মকর্তাদের পরামর্শ, এখানে সরকারের নীতি পরিবর্তন করা দরকার। বিশেষ করে আবাসিক খাতে বিদ্যমান নেটওয়ার্কের মধ্যে নতুন সংযোগ না দিলেও যাদের পুরনো সংযোগ আছে, তাদের অন্তত চুলার সংখ্যা বর্ধিত করার অনুমোদন দেওয়া পারে। কারণ এখন সবচেয়ে বেশি অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে বর্ধিত চুলায়। প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিতাসের লোকজনের পক্ষে এসব খুঁজে বের করা কঠিন। তারা বলেন, অনেক ক্ষেত্রে তিতাসের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা নিজেরা সুবিধা নিয়ে অনুমোদনহীন চুলা ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছেন।
এক হিসাব থেকে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গত ছয় মাসে তিতাসের অভিযান টিম ২২০ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন উচ্ছেদ করেছে। এই অবৈধ লাইন অপসারণের পাশাপাশি অবৈধ চুলা উচ্ছেদ করা হয়েছে দুই লাখ ২৩ হাজার ৩৬টি। এ সময়ে শিল্পে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ২৯৩টি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অবৈধ ব্যবহারের দায়ে ১৮০টি এবং বকেয়ার কারণে ১১৩টি। সূত্রমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১৬৪টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৯৯টি এবং তিতাসের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে ৬৫টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। ৫৭১টি স্থানে এসব অভিযান পরিচালনা করে পাইপলাইন ও অনুমোদনহীন চুলা অপসারণ করা হয়।
কর্তৃপক্ষ বলছে, অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ ও বন্দর এলাকায় অবৈধ সংযোগ সবচেয়ে বেশি। নারায়ণগঞ্জেই অবৈধ ১০৭ দশমিক ৯২ কিলোমিটর পাইপলাইন এবং ৯১ হাজার ৮৬৪টি চুলা উচ্ছেদ করা হয়েছে। গাজীপুর এলাকায় ৯১ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন ও ৪২ হাজার ৭২২টি বার্নার উচ্ছেদ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ডিভিশনে প্রায় ১০ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন ও প্রায় ১০ হাজার অবৈধ চুলা এবং ঢাকা উত্তরে প্রায় ১১ কিলোমিটার পাইপলাইন ও ৭৭ হাজার ৬৪৪টি অবৈধ চুলা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ময়মনসিংহ এলাকায় এক হাজার ৪০৯টি অবৈধ চুলা উচ্ছেদ করা হয়েছে।
অভিযান প্রসঙ্গে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ মোল্লা বলেন, তিতাসের সামনে দুটো চ্যালেঞ্জ। এক. অবৈধ গ্যাস সংযোগ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা, দুই. বকেয়া গ্যাস বিল আদায় করা। তবে তিতাস বিতরণ এলাকায় কী পরিমাণ অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কোনো হিসাব নেই। তবে যেখানেই অবৈধ সংযোগের খবর আমরা পাচ্ছি, সেখানেই অভিযান চালাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে আমরা যেসব এলাকায় বৈধ গ্রাহকের চেয়ে অবৈধ গ্রাহক বেশি, সেখানে পুরো এলাকার সংযোগ বন্ধ করে দেব। অবৈধ সংযোগ অপসারণ নিশ্চিত করে বৈধদের সংযোগ দেব।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিশেষ করে আবাসিক খাতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ জড়িয়ে পড়েছে। পাইপলাইনের গ্যাস সংযোগ না থাকলে বাড়ি ভাড়া দেওয়া কঠিন বলে তারা এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে। মানুষ এখনো এলপিজি সিলিন্ডারে অভ্যস্ত হতে পারেনি। এলপিজি সরবরাহ ব্যবস্থাও খুব স্বস্তিদায়ক হয়নি। ফলে আবাসিক খাতে পাইপলাইনের গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার বন্ধ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে যাদের আগে থেকে গ্যাসের অনুমোদিত সংযোগ আছে, তাদের প্রায় সবাই বর্ধিত চুলা বসিয়ে নিচ্ছে। সরকার এদের বৈধ করে দিলে বিদ্যমান গ্যাসে একদিকে রাজস্ব বাড়বে এবং অবৈধ ব্যবহারও কমবে।
এদিকে অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের চিহিৃত করতে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নারায়ণগঞ্জে বন্দরে কিছু সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তবে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সিসি ক্যামেরা দিয়ে অবৈধ ব্যবহারকারীদের দমিয়ে রাখা যাবে না। এ জন্য সরকারের কঠোর অবস্থান এবং নীতিগত পরিবর্তন দরকার।
অন্যদিকে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গ্রাহকদের সহায়তা চেয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গতকাল বৃহস্পতিবার ফেসবুকে নিজের আইডিতে এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দুই লাখের বেশি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে তিতাস। মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’ গ্রাহকের আশপাশে অবৈধ গ্যাস সংযোগ থাকলে তথ্য দিয়ে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানিকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান প্রতিমন্ত্রী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন