সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাসে জ্বালানী তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বাড়ানো নিয়ে চলছে নানা রকম আলোচনা সমালোচনা। অন্যদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) বলছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর ভর্তুকিতে তেল বিক্রি করে লোকসানে তাদের প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। বিপিসির বক্তব্যের পর প্রশ্ন উঠেছে, সত্যিই কি দেউলিয়া হতে যাচ্ছে বিপিসি? যদি তা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যাংক গ্রাহক বিপিসির হাজার হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল?
বলা হচ্ছে ভর্তুকিতে তেল বিক্রি করে ক্রমাগত লোকসান গুনতে গুনতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যার কারণে হঠাৎ এমন মূল্য বৃদ্ধি। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী বিগত ৮ বছরে তেল বিক্রিতে কোন ভর্তুকি নয় বরং মুনাফা অর্জন করেছে বিপিসি।
‘বাংলাদেশ ইকনমিক রিভিউ ২০২২’ এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জ্বালানি তেল বিক্রিতে সরকারের মুনাফার পরিমাণ:
২০১৪-১৫: ৪১২৬.০৮ কোটি টাকা
২০১৫-১৬: ৯০৪০.০৭ কোটি টাকা
২০১৬-১৭: ৮৬৫৩.৪০ কোটি টাকা
২০১৭-১৮: ৫৬৪৪.৩৭ কোটি টাকা
২০১৮-১৯: ৪৭৬৮.৪২ কোটি টাকা
২০১৯-২০: ৫০৬৬.৫৪ কোটি টাকা
২০২০-২১: ৯৫৫৯.৪৫ কোটি টাকা
২০২১-২২ (২৩শে মে,২০২২ পর্যন্ত): ১২৬৩.৭৮ কোটি টাকা
শুল্কআয় ছাড়াও এই কয়েক বছরে সরকার তেল থেকে মোট মুনাফা আয় করে ৪৮ হাজার ১২২ কোটি ১১ পয়সা। ২০১৩ সালে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের মূল্য ৯৪ ডলার থেকে কমতে কমতে ২০১৬ সালে ৪০ ডলারের নিচে নেমে আসে। কিন্তু বিপিসির পক্ষ থেকে তারপরও দাম কমানো হয়নি। কেবল ২০১৬ সালের এপ্রিলে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৩ টাকা কমানো হয়েছিল। তবুও কম দামে তেল কিনে তা দেশের বাজারে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রির কারণে প্রতি বছরই এমন হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। তাহলে এখন কেন সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ববাজার জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি, অন্যান্য দেশের সাথে জ্বালানী তেলের মূল্য সমন্বয় এসব কথা কথা হচ্ছে? বিশ্ব বাজারে যখন জ্বালানী তেলের মূল্য কম ছিল তখন কেন তেলের দাম কময়ে সমন্বয় করা হল না? সংকটের সময় জনগণের কাছ থেকে আয় করা মুনাফার টাকা খরচ না করে কেন জনগণের উপরই আবার ৫০% মূল্য বৃদ্ধি চাপিয়ে দেয়া হলো?
চলতি বছরের ১২ জুন বিপিসির তৈরি এক প্রতিবেদন বলছে, প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে মোট ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা জমা ছিল। যার মধ্যে নগদ অর্থের পরিমাণ ১১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা এবং ১৪ হাজার ১০৬ কোটি টাকা ছিল দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদী আমানত বা এফডিআর হিসেবে। এসব দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদী এফডিআর থেকেও বড় অংকের মুনাফা পায় বিপিসি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে যে, এই মুনাফার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা আইনি ক্ষমতাবলে অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়ে গেছে। এছাড়াও ব্যাংকে জমা রাখা এফডিআরের বিপরীতে সিকিউরড ওভার ড্রাফট বা এসওডি নিয়েছে বিপিসি, যা দিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। কি ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প করা হয়েছে কোথায় কত টাকা খরচ করা হয়েছে কোন প্রশ্নেরই সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
এফডিআরের বিপরীতে এসওডি নেয়া হলে বেশ চড়া সুদ গুনতে হয়। যা পরবর্তী কোয়ার্টারে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাস শেষ হলেই সুদ সহ বিপুল পরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে হবে বিপিসিকে। সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায় যে, ব্যাংকে আমানত রাখা এফডিআরের বিপরীতে এসওডি নেয়ার ফলে এমন পরিস্থিতিতে পরেছে বিপিসি। এই চাপ সামাল দিতেই কি তাহলে হঠাৎ এই মূল্য বৃদ্ধি? সাধারণ মানুষের লাভ তাহলে কোথায়? দেশের সাধারণ মানুষরা কি বারবার শুধু ঠকেই যাবে?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন