গাজীপুরের জয়দেবপুর-গফরগাঁও রেলপথের অরক্ষিত ক্রসিংগুলো বাড়িয়ে দিচ্ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আর রক্ষিত রেলক্রসিংগুলো গেটম্যানের দায়িত্বে অবহেলায় পরিণত হচ্ছে মরণফাঁদে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, জয়দেবপুর-গফরগাঁও রেলপথের জয়দেবপুর স্টেশন থেকে কাওরাইদ স্টেশন পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটারে ট্রাফিক বিভাগের ৪টি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং (পি.ডব্লিউ) বিভাগের ১৩টি রক্ষিত গেট রয়েছে। যেখানের প্রতিটিতে ৩ জন করে গেটম্যান নিযুক্ত। তবে বাস্তবে, জয়দেবপুর-গফরগাঁওয়ের ওই ৩৮ কিলোমিটার রেলপথে ছোট-বড় মিলিয়ে অর্ধশতাধিক রেলক্রসিং রয়েছে।
যেগুলোর শ্রীপুর-কাওরাইদ রেলস্টেশনের মাত্র ১৩ কিলোমিটারে রয়েছে ২৭টি পারাপারের স্থল। এসব অরক্ষিত রেলগেট মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে। শনিবার সরেজমিনে দেখা যায় ভাওয়াল গাজীপুরের বনখড়িয়া, শ্রীপুরের সাতখামাইরসহ জয়দেবপুর থেকে গফরগাঁও রেলপথের মশাখালী স্টেশনের দক্ষিণ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে বেশির ভাগই অরক্ষিত। রেল ক্রসিং দিয়ে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে বিভিন্ন যানবাহন ও মানুষজন।
সম্প্রতি গত ২৪ জুলাই সকাল সাতটার দিকে জয়দেবপুর-গফরগাঁও রেল সড়কের গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের মাইজপাড়া ক্রসিংয়ে বলাকা এক্সপ্রেস ট্রেনের সাথে শ্রমিকবাহী বাসের সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয় আরও ২০ জন। ঘটনার পরপরই সেখান দায়িত্বরত গেটম্যান আল আমীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্তের কথা জানান ময়মনসিংহ রেলওয়ের উর্দ্ধতন প্রকৌশলী নাজমুল ইসলাম। যদিও ঘটনার পর সেখানে দায়িত্বরত গেটম্যানরা গা ঢাকা দেয়। বিষয়টি তদন্তে তাৎক্ষণিকভাবে রেলওয়ের ময়মনসিংহের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী নারায়ন প্রধান সরকারকে প্রধান করে ৪ সদস্যের কমিটি করা হয়।
এদিকে, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রঞ্জন কুমার সরকারকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক। ওই কমিটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে যুক্ত করা হলেও কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের অগ্রগতি প্রকাশ করেননি।
এরআগেও জয়দেবপুর-গফরগাঁও সড়কের একাধিক স্থানে ছোট-বড় শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটলেও রেল কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ দেখা মিলেনি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তাই এসব অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ঠেকাতে দ্রুত গেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের দাবি তাদের।
ভাওয়াল গাজীপুরের বনখড়িয়া এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম, মাসুম মিয়া, শ্রীপুর উপজেলার বরমী এলাকার বাসিন্দা কমুর উদ্দিন,সাতখামাইরের কফিল উদ্দিন,কাওরাইদের জুয়েল রানাসহ অনেকেই জানান, এসব অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে প্রতিনিয়ত ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এ নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগই নেই।
অন্যদিকে, দুর্ঘটনার পর দায়িত্বে অবহেলায় অভিযুক্ত গেটম্যানদের অভিযোগ উল্টো রেলওয়ের দায়িত্বশীলদের দিকেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই দাবি করেন, রেলের পাশে গেটম্যানদের জন্য নির্মিত ছোট ঘরে নেই টয়লেট,পানি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা। অধিকাংশ গেটেই জনশূন্য থাকায় তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কর্তৃপক্ষকে জানালেও মিলেনা সমাধান।
সামিনুল নামের একজন গেটম্যান যুগান্তরকে বলেন, কয়েকটি গেটে কলিং সিগন্যাল মেশিন ও টেলিফোন থাকলেও এগুলো নিম্নমানের হওয়ায় উদ্বোধনের কিছুদিন পর বেশিরভাগই অকেজো গেছে। এখন গেটম্যানরা নিজেদের মোবাইলে যোগাযোগ করে ট্রেন আসার খবর এক গেট থেকে অন্য গেটে জানায়। সেক্ষেত্রে যোগাযোগ করতে গিয়ে অনেক সময় সংযোগ সমস্যা পড়েন তারা।
শ্রীপুরের রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার হারুন উর রশিদ বলেন, স্টেশনের আওতায় যেসকল বৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে সেগুলোতে নিয়োজিত গেটম্যান যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়াও স্টেশনের দক্ষিণ পাশে দুটি লেভেল ক্রসিং রয়েছে এগুলোতে জনসাধারণ নিজ দায়িত্বে পারাপার হন।
ময়মনসিংহ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী নাজমুল ইসলাম বলেন, আশপাশে বসবাস থাকায় যে যার যতো করে রেলপথে ক্রসিং সড়ক নির্মাণ করে নিতে চায় সাধারণ মানুষ। যেগুলো দুর্ঘটনার সৃষ্টির কারণ। আমাদের পক্ষ থেকে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে, সেক্ষেত্রে সকলকেই আরও সচেতন হতে হবে।
রেলপথ বিভাগে অর্থ ও জনবল সংকটের কথা জানিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল জোনের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা যুগান্তরকে জানান, ব্যাপক সংখ্যক রেলক্রসিং থাকায় সবখানে গেটের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই সচেতনতার দায়িত্ব সবারই। এছাড়াও, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ না করেই রেললাইন ক্রস করে রাস্তা নির্মাণ করে এলজিইডি বিভাগ। বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে কথা হয়েছে। সমন্বয় করে দুর্ঘটনা এড়াতে এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করা হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন