কোনো ধরনের গণশুনানি, পূর্বালোচনা ছাড়াই রাতারাতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এতে ক্ষুব্ধ মানুষ। তারা বলছেন, এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন বিপর্যস্ত, তার ওপর জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো মানে অসহায় মানুষের ওপর বিদ্যমান চাপে আরও ভারী করা। রাজধানীর বিজয় সরণির ট্রাস্ট ফিলিং স্টেশনে তেল কিনতে এসেছিলেন ইউসুফ আলী। তিনি বলেন, সরকার সাশ্রয়ী হতে বলছেন, অন্যদিকে আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকাকে কঠিন সংকটের মুখোমুখি করেছে। বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। গ্যাস, বিদ্যুতের দাম তো দুই মাস অন্তর অন্তর বাড়ানো হয়। এখন জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে পরিবহনে যে ভাড়া বাড়বে, তার প্রভাব পড়বে বাজারে। সরকারের যেখানে সমন্বয় করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কথা সেখানে তারা এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষকে বিপদের ?মুখে ফেলেছে। সাধারণের কথা সরকার ভাবে না।
যদি ভাবতো তাহলে তেলের দাম এতটা বাড়াতো না। ইমদাদুল হক একজন শপিংমলের বিক্রয়কর্মী। প্রতিদিন কর্মস্থলে নিজের মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন। ঢাকার হাজারীবাগে পরিবার নিয়ে থাকেন। ইমদাদুল হক বলেন, আমি মোটরসাইকেলে অকটেন ব্যবহার করি। এক লাফে লিটারে ৪৬ টাকা কোনোভাবেই বাড়ানো ঠিক হয়নি। এটি গ্রহণযোগ্যও না। মানুষের উপরে এটি জোর করে চাপানো হয়েছে। এদেশে সাধারণ মানুষের কোনো মূল্য নেই।
খুবই নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। মধ্যবিত্তরা না পারে কারও কাছে হাত পাততে, না পারে কষ্টের কথা বলতে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সকল পণ্যের আরও দাম বেড়ে যাবে। এমনিতে মাস চালাতে হিমশিম খাই এরমধ্যে আবার নতুন করে বাইকের প্রতি আরও খরচ যুক্ত হলো। মো. রহমাতুল্লাহ। তিনি রাইড শেয়ারিং করেন। এই আয় দিয়েই চলে তার সংসার। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় খুব শোচনীয় অবস্থায় আছি। যাত্রীদের কাছে যে ভাড়া চাচ্ছি সেইটা দিচ্ছে না। রাগারাগি করে যাত্রীরা চলে যাচ্ছে। আমরা মুখ খুলেও কিছু বলতে পারি না। সকাল থেকে বসে আছি কোনো যাত্রী নিতে পারিনি। আমাদের বেশি দামে তেল কিনতে হচ্ছে কিন্তু ভাড়া বেশি পাচ্ছি না। সরকার যাত্রী এবং আমাদের সঙ্গে বড় একটা বৈষম্য তৈরি করে দিয়েছে। আগের দামই ভালো ছিল। তেলের দামের হিসাব করলে আমার আয় আরও কমে গেল। বাজারে যে জিনিসটাই আমি কিনতে যাবো তার প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বাড়তি। রাইড শেয়ারিং করে সংসার চালানো কষ্টকর। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিস্থিতি যে আরও কত ভয়াবহ হবে সেটি চিন্তার বিষয়। এখন কি ঢাকায় থাকবো নাকি গ্রামে যাবো সেই সিদ্ধান্তও নিতে পারছি না। সরকারের মুখে সবসময় শুনে এসেছি দেশে খাবারের কোনো ঘাটতি নেই। অথচ মানুষ খুব খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আছে। আমি মোহাম্মদপুরে পরিবার নিয়ে থাকি।
বাবা-মা, বোন ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনোমতে জীবন-যাপন করি। একটি হাসপাতালে চাকরি করতাম। সমস্যার কারণে চাকরি ছেড়ে রাইড শেয়ার করি। যেখানে যাচ্ছি সব জিনিসের আগুনের মতো দাম। অন্য সময় প্রায় অনেক রাত পর্যন্ত তেল বিক্রি করে পাম্পগুলো আর গতকাল ঘোষণার পর বন্ধ করে দিয়েছে। সারাদিন তেল খরচ করে গাড়ি চালিয়ে বাজারে গেলে সব টাকা শেষ। এখন আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। মাসে সংসারে ৪০ হাজার টাকার মতো খরচ হয় কিন্তু এই টাকা আয় করাই কষ্টকর। বর্তমানে লোন নিয়ে সংসারের খরচ চালাতে হচ্ছে। চা বিক্রেতা মনির হোসেন। তিনি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চায়ের পানি বাসা থেকে গরম করে নিয়ে আসেন। মনির হোসেন বলেন, তেলের দাম বাড়ায় বাসা থেকে চায়ের পানি গরম করে নিয়ে এসেছি। দিনে দুই লিটার কেরোসিন লাগতো। চায়ের পানি শেষ হলে আবার বাসা থেকে পানি গরম করে নিয়ে আসবো। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ছেলে-মেয়েরা ভালো খেতে চায়। কিন্তু ইনকাম কম। মাছ-মাংসের কথা ভুলে গেছি। আগে আমি মেকানিকের কাজ করতাম। একবছর আগে গাড়ি দুর্ঘটনায় পা ভেঙে গেছে। এই চায়ের দোকানই আমার ভরসা। তেলের খরচটা বেড়ে যাওয়ায় আরও দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে। গরিবের দুঃখ সারাজীবন থাকে। আমাদের গরিবের কথা কে শুনবে।
এত বছর বয়স হয়েছে এমন দুর্ভোগ জীবনে দেখিনি। দিনে দুই কেজি কেরোসিন খরচ হতো। দাম বাড়ায় এখন পোষায় না এজন্য ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছি। দোকানে যে জিনিসপত্র নিয়ে আসি সেগুলোর দামও বাড়তি। চা ছাড়া কেউ অন্য কিছু খেতে চায় না। কিন্তু আমার চালান তো ঠিকমতো উঠে না সংসার চলবে কীভাবে। কে বুঝবে আমাদের কষ্ট। যে পরিমাণ দাম বাড়িয়েছে এত বাড়ানো ঠিক না। সরকারের সঙ্গে কি আমরা যুদ্ধ করে পারবো। যেভাবে চালাচ্ছে আমাদের সেইভাবে চলতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাদিক হাসান পলাশ বলেন, শুধু তেল না, সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে সম্ভবত ঢাকায় আর থাকা হবে না। আমার সীমিত আয়ের মধ্যে আগে প্রতিদিন বাইকে বরাদ্দ ছিল ১০০ টাকা। এখন সেখানে লাগবে প্রায় ২০০ টাকা, কীভাবে খরচ করবো? আরেক বাইকার বলেন, একটা গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে সবকিছু হয়ে যাচ্ছে। আমরা মেনে নিচ্ছি, মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। সরকার রাতের আঁধারে তেলের দাম ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
এটা কি ভাবা যায়? তিনি বলেন, এখন ৫০০ টাকার তেল কিনলে ৩ লিটারের কিছুটা বেশি হচ্ছে, যেখানে একই টাকায় আগে ৬ লিটার তেল পাওয়া যেত। তালতলা ফিলিং স্টেশনে তেল কিনতে আসা সাঈদ রিপন বলেন, হঠাৎ তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার নিজেদের বোঝা হালকা করছে। তিনি বলেন, আমাদের আসলে কিছুই বলার নেই, কারণ আমরা বললে কোনো লাভও হয় না। সাধারণ মানুষের কথায় সরকারের কিছু যায় আসে না। স্টার ফিলিং স্টেশনে তেল কিনতে আসা ইমরান হোসেন বলেন, এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস, তার ওপর তেলের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো মানে অসহায় মানুষের পেটে আঘাত করা। তিনি বলেন, জনগণের টাকা সুইস ব্যাংকে পাঠিয়ে এখন আবার জনগণের পকেট কাটতে আরম্ভ করলেন। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে আর আমাদের তেলের দাম বাড়ে। আসাদ গেটের মেসার্স তালুকদার ফিলিং স্টেশনে তেল কিনতে আসা ওহিদুল ইসলাম বলেন, সরকার আমাদের যেভাবে মনে চায় সেভাবে চালাচ্ছে। আজকে মনে চেয়েছে ৫০ টাকা বাড়াইলাম, বাড়ায় দিছে। আবার মনে চাইবে ১০০ টাকা বাড়ায় দিবে। উনাদের যেভাবে মনে চায় সেভাবেই বাড়াচ্ছে।
আমাদের কিছুই করার নেই। শুধু সহ্য করে যেতে হবে। ইদ্রিস নামের আরেক ক্রেতা বলেন, বন্ধের দিনে এভাবে হুট করে তেলের দাম বাড়ানো সরকারের একটা অমানবিক সিদ্ধান্ত। পাবলিকের টাকায় তারা ক্ষমতায় আছে। এভাবে আর কত দিন? অফিসে উবারে যাতায়াত করেন মাহমুদুল হক। তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে তার যাতায়াতের ভাড়া বাড়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এখন আমার পার রাইডে ৭০ থেকে ৮০ টাকা করে বেড়ে যাবে। বাসে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রেও ভাড়াটা বেশি গুনতে হবে। কিংবা পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রেও বেশি টাকা দিতে হবে। শিক্ষার্থী আবরার বলেন, সরকার অযথা জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অকটেন-ডিজেল আমাদের বাইরে থেকে আনতে হয় না। এসব কিছুর দাম কোনোভাবেই নাকি বাড়বে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন