আসছে ঈদ। এই ঈদ ঘিরে বাড়বে পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও অন্য সব ধরনের মসলার চাহিদা। দেশের বাজারে পেঁয়াজের বাজার কিছুটা অস্থিতিশীল হলেও অন্য সব মসলারই সরবরাহ ও দাম মোটামুটি স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে। চট্টগ্রামে মসলার পাইকারি বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অন্যান্য বছর পবিত্র ঈদুল আজহার অন্তত ১৫ দিন আগে মসলার পাইকারি বাজার জমে ওঠে। তবে এবার ব্যতিক্রম। চট্টগ্রামে মসলার পাইকারি বাজার ধীরে ধীরে জমছে। পাইকারি বাজারে ক্রেতা কম থাকায় অন্য বছরের চেয়ে এবার বিক্রিও কম। বাজারে এলাচ, লবঙ্গ, জিরা, গোলমরিচ, দারচিনির মতো মসলার দাম খুব একটা বাড়েনি।
তবে এবার খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজ নিয়ে বেশ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির পারমিট বা আইপি দেওয়া হবে ২৯ কিংবা ৩০ জুন, এমন গুঞ্জনে গত বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) দুপুরে পেঁয়াজের কেজি নেমে আসে ৩৯ টাকায়। পরে এই গুঞ্জনের সত্যতা না মেলায় বিকেলেই আবার পেঁয়াজ ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। শুক্রবার বাজার বন্ধের পর গতকাল শনিবার একই পেঁয়াজ (দেশি) ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। পেঁয়াজের পর কোরবানির অন্যতম প্রয়োজনীয় মসলা আদা ও রসুনের দাম বাড়েনি। এই দুটি পণ্য আগের দামেই বিক্রি করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট মসলার চাহিদা ৩৩ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ২৭ লাখ টন। বাকি ছয় লাখ টন আমদানি করেই চাহিদা মেটানো হয়। এই মসলার মধ্যে গরম মসলা এলাচ, লবঙ্গ, জিরা ও দারচিনির মতো অন্তত ৩০ ধরনের পণ্যের চাহিদা কত তার হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৯ সালের তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গরম মসলা আমদানি হয়েছে দুই লাখ ২২ হাজার টন, যার আমদানি মূল্য দুই হাজার কোটি টাকা।
পেঁয়াজ
গত মে মাস থেকে ভারতের পেঁয়াজ আমদানিতে আইপি বন্ধ রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অতীতের নেতিবাচক অভিজ্ঞতায় দেশে এবার পেঁয়াজের আবাদ বাড়ানোর পাশাপাশি ফলনও অনেক বেড়েছে। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছে। এর পর থেকে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পেঁয়াজ আমদানির দাবি জানাচ্ছেন। তবে সরকার তাতে সায় দেয়নি। সর্বশেষ সিলেটসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে কৃষকের ঘরে থাকা পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। কোরবানির ঈদে পেঁয়াজের চাহিদা অনেক। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংস্থা ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির পরামর্শ দেয়। সেই প্রস্তাব বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন। ওই প্রস্তাবে সরকার অনুমতি দিচ্ছে—এমন গুঞ্জনে বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়।
পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ দপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত উপপরিচালক অঞ্জন চন্দ্র মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আপনার মতো আমিও পত্রপত্রিকায় খবরটি দেখেছি। তবে আমরা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা পাইনি। সরকারি প্রজ্ঞাপন পেলেই অনুমোদন দেওয়া হবে। ’
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, মে মাসের পর থেকে বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছে দেশি পেঁয়াজ। চট্টগ্রামে আগে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হতো না বললেই চলে। এবার দেশে পেঁয়াজের একটি ভালো জাত উৎপাদন হওয়ায় চট্টগ্রামেও এর কদর বেড়েছে। খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘দেশি পেঁয়াজ যে এত ভালোভাবে বাজার দখল করবে, কখনো চিন্তা করিনি। বর্তমানে বাজারে দেশি পেঁয়াজ মানভেদে ৪১ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ দাম কমে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। দামের অস্থিরতার কারণে খুচরা ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা পরিস্থিতি দেখে কেনার কৌশল নিয়েছেন। ফলে বাজারে ক্রেতা কম। তবে প্রচুর পেঁয়াজ আছে বাজারে। ’
আদা
খাতুনগঞ্জে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা চীন ও মিয়ানমারের আদার। বাজারে দেশি আদা থাকলেও চাকচিক্যে পিছিয়ে থাকায় বিদেশি আদার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। বাজারে আদার দাম কিছুটা বেড়েছে। চীনা আদা ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। আর মিয়ানমারের আদা ৩০ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের তৈয়বিয়া ট্রেডার্সের কর্ণধার সোলায়মান বাদশা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব সময় আমরা দেখেছি, কোরবানির এক মাস আগে থেকে বাজারে মসলাজাতীয় পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। এবার তার লক্ষণ দেখছি না। ঈদের আগে হাতে আছে আর সাত দিন, এই সময়ে বিক্রি কতটা বাড়বে তা বুঝতে পারছি না। ’
তিনি বলেন, ‘আদা-রসুনের মতো মসলা বর্তমানে কেনা দামের চেয়ে বাজারে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। বেচাকেনা কম হওয়ার কারণ ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কম। ক্রেতারা আগের মতো জৌলুস নিয়ে কেনাকাটা করছে না। এই সংকট চলতে থাকলে কোরবানির ঈদের পর এসব পণ্যে নতুন সংকট তৈরি হবে। ’
রসুন
খাতুনগঞ্জে দেশি রসুনের পাশাপাশি দুই দেশের রসুন বিক্রির শীর্ষে রয়েছে। চীনা রসুন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯০ থেকে ৯২ টাকা দরে। আর ভারতীয় রসুন ৪০ টাকা কেজি। দেশি রসুন প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স শাহাদাত অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনা রসুনের চাহিদা বেশি। কিন্তু আমদানি বাড়েনি। রমজানের ঈদের পর চীনা রসুন আমরা পাইকারিতে বিক্রি করেছি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে। আর দেশি রসুন বিক্রি করেছি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে। এখন সেই চীনা রসুন বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায় আর দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। ’
গরম মসলা
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, পণ্য পরিবহনে কনটেইনার-জাহাজ ভাড়া বেশি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে ঈদুল ফিতরের পরই সব ধরনের মসলার দাম বেড়েছিল। তখন জিরা, লবঙ্গ, এলাচ, গোলমরিচ, দারচিনিসহ গরম মসলার দাম কেজিতে ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছিল। তখন ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করেছিলেন, কোরবানিতে মসলার দাম আরো বাড়বে। বাস্তবে হয়েছে উল্টো। কোনো মসলার দামই নতুন করে বাড়েনি।
রোজার ঈদের পর এলাচ বিক্রি হয়েছিল প্রতি কেজি এক হাজার ৩৫০ টাকা দরে, এখন সেটি এক হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একজন ক্রেতার ১০০ গ্রামের বেশি এলাচ কেনার প্রয়োজন হয় না। ফলে কেজিতে ৫০ টাকা বাড়লেও চিন্তার কিছু নেই। জিরাও বিক্রি হচ্ছে আগের দামে, প্রতি কেজি ৪০০ টাকা। প্রতি কেজি লবঙ্গ এক হাজার টাকা, দারচিনি ৪০০ টাকা, গোলমরিচ ৫৫০ টাকা। শুধু এলাচ ছাড়া অন্য মসলার দাম বাড়েনি।
বাংলাদেশ মসলা আমদানিকারক সমিতির সহসভাপতি অমর দাশ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মসলাজাতীয় পণ্যের বেচাকেনা একেবারেই কম। ভোক্তারা চাল-ডালের মতো নিত্যপণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে মসলাজাতীয় পণ্য কিনছে নিতান্তই কম। এই কম কেনার প্রভাব বাজারে পড়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে এসব মসলার দাম বাড়ায় গত ঈদে এসব মসলার দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু ক্রেতার দেখা তো মেলেনি। দেশে চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানিও কমে গেছে। নতুন পরিস্থিতিতে ক্রেতারা এখন এসব পণ্য কিনতে সংযমী হয়েছে। ’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন