একমাস পূর্বে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে এক কেজি কাঁচা মরিচের দাম ছিলো ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এক মাসের মাথায় দাম দ্বিগুণ বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে। এক বছরের ব্যবধানে কাঁচা মরিচের দাম ১৫৬ শতাংশ বেড়েছে বলে সরকারি সংস্থা টিসিবি জানিয়েছে। এক কেজি শসার দাম এখন ৬৫ তেকে ৬৭ টাকা। টিসিবি বলছে বছর ব্যবধানে শসার মূল্য বেড়েছে ৫০ শতাংশ। লম্বা বেগুনের দাম ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি। এক বছরে বেগুনের মূল্য বৃদ্ধির হারও ১০০ শতাংশ বলে জানিয়েছে টিসিবি।
কাঁচামরিচ, শসা, বেগুন এগুলোর কোনটিই ইউক্রেন, রাশিয়া বা ভারত থেকে আসার তথ্য নেই দেশের মানুষের কাছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে চলে গেছে আলু, শসা, মরিচ, বেগুনের দাম।
একেবারে সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ যে মোটা চাল কিনে খান, সেই চালের কেজি এখন ৪৯ থেকে ৫১ টাকা। আর মধ্যবিত্তদের নাজির-মিনিকেট ৭১ থেকে ৭৬ টাকা কেজি। সয়াবিন তেল বাজার থেকে যেন উধাও। পাওয়া গেলেও, কিনতে হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা লিটার দরে। ৫ লিটারের এক বোতল তেল কিনতে ১ হাজার থেকে ১১শ’ টাকা ব্যয় করছেন ক্রেতারা।
শুধু ভোজ্যতেলের কথা ধরা যাক। মধ্যম আয়ের পাঁচজনের একটি পরিবারে গড়পড়তা ৫ লিটার সয়াবিন তেল লাগে। টিসিবির হিসাবে, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ৫ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৪৬৫ থেকে ৫১০ টাকা, এখন তা দ্বিগুণেরও বেশি। মানে হলো, শুধু সয়াবিন তেল কিনতে একটি পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ১২০ থেকে ১২৫ শতাংশ।
কাঁচাবাজারে মাছ, মাংস ও সবজির দাম নিয়মিত ওঠানামা করে। তবে বিগত এক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, ফার্মে উৎপাদিত মুরগির দাম বছর জুড়েই বেশি থাকছে। যেমন ব্রয়লার মুরগির দাম এখন বছরের বেশির ভাগ সময় প্রতি কেজি ১৫০ টাকার বেশি থাকে। করোনার আগেও এই দর ১২৫-১৩০ টাকার আশপাশে থাকত। বিক্রেতাদের দাবি, মুরগির বাচ্চা, খাবারের দাম ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই আর আগের দামে ফেরার আশা কম।
নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবার কালেভদ্রে এখন গরুর মাংস কিনতে পারেন। এখন বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকা। তিন বছর আগে এই সময়ে ছিল ৫০০ টাকার নিচে।
গত রমজানের শুরুতেই বাজারে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম এক দফা বেড়েছিল। পুরো রমজানে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। এই ধাক্কা সামলানোর আগেই এখন নতুন করে বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
বিভিন্ন মুদিদোকান ও কাঁচাবাজারের শুধু খাদ্যপণ্য নয়, বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও। এক বক্স টিস্যু পেপারের দাম ১০ টাকা বেড়েছে। ৯০ টাকায় এক কেজি গুঁড়া সাবান পাওয়া যেত। এখন তা ১০৫-১১০ টাকা। বেড়েছে অন্যান্য জিনিসের দামও।
বাজারের চড়া দামে মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন বলে জানান দোকানিরা। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার এক দোকানি রকিব উদ্দিন বলেন, সব জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। শুক্রবারে মানুষের ঢল নামতো এ মার্কেটে, এখন একদমই মানুষ নাই। মানুষের কেমনে কিনবে, মানুষের হাতে টাকা নাই। আর আমাদের মতো ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খারাপ।
দাম বেড়েছে শিক্ষা উপকরণেরও। একটি খাতার দাম ২০ থেকে বেড়ে এখন ৩০ টাকা হয়েছে। ৫ টাকার পেনসিলের দাম এখন ১৫ টাকা। ২০২১ সালের শুরুতে যে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস সিলিন্ডার (১২ কেজি) ৮০০-৮২০ টাকা ছিল, তা এখন সাড়ে পনের শ’ টাকা। এটা সরকার নির্ধারিত মূল্য হলেও, ক্রেতারা কিনছেন মূলত ১৭০০ থেকে সাড়ে সতের শ’ টাকায়।
ব্যয়ের সব খাতে এই চাপ এমন একটা সময় পড়েছে, যখন করোনার কারণে দেশের মানুষের একটি অংশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। ঢাকার রাস্তায় মাঝে মধ্যে সরকারি সংস্থা টিসিবির দু/একটি ট্রাক চোখে পড়ে। আর এগুলোতে শ’ শ’ মানুষের লাইন দেখলেই পরিষ্কার হয়ে উঠে মানুষ কত অসহায়। ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে অনেকেই আবার খালি হাতে বাড়ি ফিরে যান।
করোনাকালে নতুন দারিদ্র্য বেড়েছে বলে বিশ্লেষণ ও জরিপের মাধ্যমে দেখিয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), পিপিআরসি ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। সানেম বলেছিল, দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য সরকার এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে। যদিও সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কোনো জরিপ বা বিশ্লেষণ তুলে ধরেনি। ২০২০ সালের অক্টোবরে এক জরিপে তারা মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার তথ্য জানিয়েছিল।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, ৪ কোটি ৮২ লাখ মানুষ প্রকৃত বেকার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শ্রমশক্তির বাইরে ছিল ৪ কোটি ৬৬ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। বেকারত্বের কারণে ৭৮ লাখ বাংলাদেশী বর্তমানে বিদেশে কর্মরত। আর দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে শতকরা ৪৭ ভাগ বেকার।
গত নভেম্বরে ডিজেলের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেয় সরকার। কৌশলগত পণ্যের ওপর প্রায় ৩৪ শতাংশ কর রয়েছে। সেখানে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে ‘সিটিং সার্ভিসে’র নামে বেশি ভাড়া আদায়, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নেওয়াও বন্ধ হয়নি বলে অভিযোগ করছেন যাত্রীরা। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) মালিকদের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই ছাড়াই লঞ্চভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষকে ৩৫ থেকে ৪৬ শতাংশ বেশি ভাড়া দিয়ে লঞ্চে চড়তে হচ্ছে। মানুষের দুর্দশার মধ্যে দাম কমাতে খুব একটা উদ্যোগ না থাকলেও বাড়াতে তৎপর সরকারি সংস্থাগুলো।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। যারা বাজারে গিয়ে নিজেদের অসহায় মনে করে, তাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। নতুবা সরকার শুনবে না। আমরা তো প্রতিদিনই এগুলো নিয়ে চিৎকার করছি, কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কয়দিন পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি তুলবেন তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য। সরকার হয়তো তাই-ই করবে। সাধারণ মানুষের তো আয় বাড়ছে না। কষ্টটা তাদেরই বেশি হবে।
নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে জীবনযাত্রায় বাড়তি ব্যয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে মানুষের জীবন। সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। এসব পরিবার দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে গিয়ে পড়ছে বিপাকে। তাদের গচ্ছিত সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। তারপর শুরু হয় ধার দেনা। সেই পথও বন্ধ পুরনো দেনা শোধ করতে না পারার কারণে। বাজারে মানুষের কষ্টের যেন সীমা নেই। কিন্তু নাকাল মানুষের এমন দুর্দশাকে মশকরা করে উন্নয়নের ফিরিস্তি চলছে দেশে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন