রোয়াইলবাড়ি। আরবি রোয়াইল ও বাংলা বাড়ি শব্দের সমন্বয়ে গ্রামটির নাম। এটি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি-আমতলা ইউনিয়নে। রোয়াইল অর্থ ক্ষুদ্র অশ্বারোহী বাহিনী।
সত্যিই বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী ছিল নেত্রকোনার রোয়াইলবাড়িতে। ছিল বৃহদাকার এক দুর্গ। কিন্তু মুঘল আমলে নির্মিত এ দুর্গ এখন শুধু ধ্বংসস্তূপ। মাটি চাপা ইতিহাস।
জানা যায়, দশম শতক পর্যন্ত কামরুপ রাজবংশ বা প্রাগজ্যোতিষ রাজন্যবর্গ এ অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। বিভিন্ন সময়ে অঞ্চলভিত্তিক যুদ্ধ এবং রাজ্যের সীমান্ত রক্ষার প্রয়োজনে এ রোয়াইলবাড়িতে আবাসস্থলসহ দুর্গপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়। গৌড়ে মুসলমান রাজন্যবর্গ আগমনের পর থেকেই আসাম কামরুপ বা প্রাগজ্যোতিষ রাজ্য জয়ের জন্য মুসলমানরা অভিযান চালাতে থাকে। সর্বশেষ যুদ্ধে পরাজিত হতে হয় কামরুপ প্রাগজ্যোতিষ রাজন্যবর্গকে।
কেদারনাথ মজুমদারের ময়মনসিংহ জেলার ইতিহাস গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, জয়-পরাজয়ের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলার সুলতান হুসেন শাহ কামরুপ জয় করার পর এর শাসনভার তার পুত্র নূসরত শাহকে দেন। পরে কামরুপ রাজা কর্তৃক নূসরত শাহ বিতাড়িত হয়ে পালিয়ে এসে রোয়াইলবাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে নূসরত শাহ সম্পূর্ণ প্রদেশের নামকরণ করেন নূসরতশাহী।
আরো পরে অঞ্চলটি ঈশা খাঁর অধিকারে আসে। ঈশা খাঁ যুদ্ধ অভিযানে এ রোয়াইলবাড়ির দুর্গ দখলে নেন। ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর তারই এক সভাসদ দেওয়ান জালাল এর শাসনভার গ্রহণ করেন। এ সময় দুর্গের বহিরাঙ্গনে একটি সুরম্য মসজিদ নির্মাণ করেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ১৯৮৭ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়াধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রোয়াইলবাড়িকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এ প্রত্নতত্ত্ব প্রায় ৪৬ একর ভূমিবেষ্টিত। ১৯৯৩ সালের ২৪ মার্চ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর রোয়াইলবাড়িতে খনন কাজ শুরু করে। দীর্ঘ খনন কাজের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দুর্গের চওড়া বেষ্টনী, বেশ কিছু কক্ষবিশিষ্ট সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত ইমারত ভেসে ওঠে। ইমারতের ইটগুলো প্রাচীন শিল্প নিদর্শন লতাপাতা, ফুলে আঁকা রঙিন প্রলেপযুক্ত। খনন কাজে বেরিয়ে এসেছে কারুকাজ করা ১২টি দরজা, ৫টি খুৎবা পাঠের মেহরাব (মিম্বর), মার্বেল পাথরের তৈরি পিলার সম্বলিত পোড়ামাটির মসজিদ। মসজিদটি ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট ছিল বলে ধারণা করা হয়। মসজিদের প্রতিটি দেয়াল ৭ ফুট চওড়া। একটি প্রাচীন কবরস্থানেরও সন্ধান মেলে।
মূল দুর্গটির দৈর্ঘ্য ৪৫০ মিটার, প্রস্থ ১৫৭ মিটার। দুর্গ এলাকা তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। দুর্গাভ্যন্তর, বহিরাঙ্গন ও প্যারেড গ্রাউন্ড। সম্মুখভাগে পূর্ব দিকে আছে দুটি দীঘি। এর একটির দৈর্ঘ্য ২০৭ মিটার, প্রস্থ ৭০ মিটার। অপরটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার, প্রস্থ ৯০ মিটার। দুর্গের দক্ষিণে আছে খোলা ময়দান। একে সেনাবাহিনীর প্যারেড গ্রাউন্ড বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। মসজিদের বহিরাঙ্গনে দুর্গের পশ্চিম পাশঘেঁষে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বেতাই নদী ও নোঙ্গরঘাট।
খননকাজ বন্ধ হওয়ার পর দুর্গ এলাকায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত এলাকা লেখা একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়েছিল। এরপর এখন পর্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে এলাকাটি।
স্থানীয় শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান বলেন, 'রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুর্গ এলাকা এখন অরক্ষিত। অযত্ন অবহেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক নানা মূল্যবান নিদর্শন বিলীন হওয়ার পথে'।
এলাকাবাসী জানায়, রোয়াইলবাড়ির প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য বহু পর্যটক আসেন। পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য রোয়াইলবাড়িকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দাবি জানান এলাকাবাসী।
কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মঈন উদ্দিন খন্দকার বলেন, দুর্গটির সৌন্দর্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এটি অন্যতম পর্যটক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন