করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের তাণ্ডবে ফের ধাক্কা লেগেছে মাঠের রাজনীতিতে। তবে এ সুযোগে সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি গুছিয়ে রাখতে চায় মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। এর অংশ হিসাবে বৃহৎ ঐক্য গড়তে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তার আগে জামায়াতকে জোটে রাখা, না রাখা নিয়ে অবস্থানও স্পষ্ট করতে চায়। এই ইস্যুতে শুক্রবার দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক ডেকেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সোমবার অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে দেশের চলমান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বেশিরভাগ নেতা জানান, করোনা সংক্রমণ বাড়ছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধ জারি করলেও তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি থামিয়ে দিতেই এই ধরনের বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু কোনো অবস্থায় আমাদের থেমে যাওয়া উচিত হবে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে অনুষ্ঠিত নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা যাচাই করা সম্ভব হয়েছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা চাঙাভাব তৈরি হয়েছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতেও তারা ভয় পায়নি। নেতাকর্মীদের এ চাঙ্গাভাব ধরে রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে দলীয় কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জোর দিতে হবে বৃহত্তর ঐক্যের দিকেও। বৈঠকে জাতীয় ঐক্য ও জামায়াত ইস্যুতেও আলোচনা হয়। নিরপেক্ষ সরকার দাবিতে চলমান আন্দোলনকে সফল করতে জাতীয় ঐক্য গড়ার কার্যক্রম পুরোদমে চালু করা উচিত। বিধিনিষেধের মধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন নেতারা।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার বিষয়টি ফায়সালা হওয়ার পর আমরা আমাদের মূল দাবি নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন শুরু করব। এ দাবিতে ডান ও বামপন্থি সব রাজনৈতিক দলের বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করব। ইতোমধ্যে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, বৃহৎ ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম গড়তে প্রয়োজনে বিএনপি তাদের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টে পরিবর্তন আনতে পারে। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, অভিন্ন দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের উদ্দেশ্যে এই ঐক্য গড়ে তুলতে চান তারা।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকায় বাম রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আপত্তির কথা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেশিসহ পশ্চিমা দেশসমূহ জামায়াত বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এই অবস্থায় হঠাৎ করে সোমবার দলের ভার্চুয়াল বৈঠকে জাতীয় ঐক্য গঠন ও জামায়াত প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা ওঠে। সেখানে কয়েক নেতার মতামতের পর আরও আলোচনা করার সিদ্ধান্ত হয়।
ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি মনে করে, বর্তমান আওয়ামী লীগের অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর, সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ। এর কোনো বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি ও জনগণের ঐক্য গড়ে তুলে দুর্বার গণআন্দোলনের মাধ্যমে এই পরিবর্তন আনতে হবে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েক নেতা জানান, জামায়াতের বর্তমান কর্মকাণ্ডে বিএনপিতে নানা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তবে এখনই জামায়াত বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের জন্য বেশ কঠিন। কারণ জামায়াতকে ছেড়ে দিলে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে কিনা সেদিকটাও ভাবতে হচ্ছে।? তাই জামায়াতকে জোটে রেখে ডান-বাম সব দল নিয়ে কীভাবে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা যায় সেই কৌশলের ওপর জোর দিচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ চলমান রয়েছে। এই উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে আমন্ত্রণ পেয়েও অংশ নেয়নি বিএনপি। এই সংলাপে সিপিবি, বাসদ ও ইসলামী আন্দোলনও অংশ নেয়নি। অংশ নেয়নি ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও মুসলিম লীগ। তবে, মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি এই সংলাপে অংশগ্রহণ করেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল গণফোরামও রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশগ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রপতির সংলাপে কল্যাণপার্টি ও গণফোরামের অংশ নেওয়া নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে বৃহৎ ঐক্য গড়ার প্রতি জোর দেওয়ার পক্ষে মত দেন নেতারা।
জানা গেছে, বাম গণতান্ত্রিক জোটের কয়েকটি দল এবং ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছে। এ প্রসঙ্গে দলটির এক নেতা জানান, নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সরকারবিরোধী সব পক্ষকে এক টেবিলে বসানোর যে ভাবনা নিয়ে তারা এগোচ্ছেন, তা বিদ্যমান জোটকাঠামোতে সম্ভব না-ও হতে পারে। সরকারবিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতার মনোভাব থাকায় ২০ দল কিংবা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কাঠামোতে পরিবর্তন হতে পারে। তবে বৃহৎ ঐক্যের দলগুলোর মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো জোট গঠন না করে যুগপৎ আন্দোলনের কথাই ভাবছেন তারা।
এ লক্ষ্যে বিএনপি কয়েক মাস আগে একটি রূপরেখাও তৈরি করেছে, যা জাতির সামনে তুলে ধরে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবে দলটি, যেখানে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার ওপরেই জোর দেওয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন