বছর তিনেক আগেও পাহাড়ে স্থানীয় পণ্যের যে দাম ছিল, এখন তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা দেখতে পেয়েছেন, পাহাড়ের মানুষের একটা বড় দুঃখ হলো চাঁদা। জীবিকার জন্য তারা যা-ই করতে যাক না কেন, সব ক্ষেত্রেই চাঁদা গুনতে হয় তাদের। কাপ্তাই হ্রদের জেলে থেকে শুরু করে কাঠের ব্যবসায়ী কিংবা ক্ষুদ্র দোকানি- সবাইকেই চাঁদা দিতে হয়।
এই চাঁদাবাজির অভিযোগে সবসময় আলোচনায় থাকে- পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জেএসএস সংস্কার ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। তারা চাঁদাকে বলে ‘ট্যাক্স’।
রাঙামাটি জেলার নানিয়াচর খারিক্ষংপাড়ার বিমল চাকমা একজন শিক্ষক। জানালেন, একজন দিনমজুর, যার কোনোই সঞ্চয় নেই, তাকেও বছরে ন্যূনতম ২০০ টাকা ‘ট্যাক্স’ দিতে হয়। চার সংগঠন নিজেদের দখলে থাকা এলাকায় এই ‘ট্যাক্স’ তোলে। যেসব এলাকায় একাধিক দলের আধিপত্য রয়েছে, সেখানে একাধিক দলকেই চাঁদা দিতে হয়।
পাহাড়ে গত ৩ বছরের চাঁদাবাজি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সেটির একটি কপি আমাদের সময়ের পক্ষ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবছরই চাঁদার পরিমাণ বাড়ছে। সর্বশেষ ২০২০ সালে চাঁদাবাজির পরিমাণ ছিল ৩৮১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হয় খাগড়াছড়িতে, দ্বিতীয় অবস্থানে রাঙামাটি; এর পর বান্দরবান। ২০২০ সালে খাগড়াছড়িতে চাঁদাবাজি হয় ১৩৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। রাঙামাটি ও বান্দরবানে এর পরিমাণ যথাক্রমে ১২২ কোটি ১৯ লাখ এবং ১১৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
রাঙামাটি জেলা পুলিশ সুপার মীর মোদাচ্ছের হোসেন চাঁদাবাজিকে পাহাড়ের জন্য খুবই অস্বস্তিকর আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘পাহাড়ের ৯৫ শতাংশ লোকই শান্তি চায়। বাকি ক্ষুদ্র অংশটি চাইলেই টাকা পাচ্ছে। এক ছড়া কলা বিক্রি করতেও তাদের টাকা দিতে হয়। একটা মোরগ বিক্রি করবে ৪০০ টাকা। তার থেকে ৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। যারা দেয়, ভয়ে দেয়, জীবন বাঁচানোর জন্য দেয়। যারা চাঁদা নেয়, তারা হঠাৎ হঠাৎ আসে। সব মসময় আসে না। পাহাড়ের ভেতরে থাকে। তাদের যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা আলো-বাতাসে থাকেন।’
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি আসার পর বাঘাইছড়িতে ২টি খুন হলো চাঁদাবাজির ঘটনায়। এখানকার ছেলেরা লেখাপড়া করে বড় বড় চাকরি পাচ্ছে। চাকরিতে ঢুকে নিজেদের বাড়ি যেতে পারে না। ৩৮তম বিসিএসে পুলিশে চাকরি পান রিপন চাকমা। আমার সাথে দেখা করে বলেন, বাবা-মা বাড়ি যেতে নিষেধ করেছেন। কেন করেছেন? রিপন বললেন, বাড়ি গেলে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জেনেছি, যারা এখানকার নেতা, তাদের ছেলেরা থাকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায়। তারা এসব চাঁদার ভাগ পায়।’
পুলিশ সুপার বলেন, ‘তাদের কিছু লোক বাইরে থেকে হঠাৎ হঠাৎ এসে জুমল্যান্ডের বাণী প্রচার করছেন। কয়েকদিন থেকে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে আবার চলে যাচ্ছেন। ইদানিং নতুন করে জুমল্যান্ডের ধারণা প্রচার করা হচ্ছে।’
পাহাড়ে অপরাধের ধরন বিশ্লেষণ করে পুলিশ সুপার বলেন, ‘শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ি-বাঙালিদের দূরত্ব কমে এসেছিল। এখন তা ক্রমেই বাড়ছে। এক্ষেত্রে সমস্যা কারা করছে জানেন, এই চাঁদাবাজরা।’
চাঁদাবাজির সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) প্রচার সম্পাদক নগেন্দ্র চাকমা আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরাও শুনেছি পাহাড়ে চাঁদাবাজির কথা। তবে অনেকে সহযোগিতা আর চাঁদাবাজিকে এক করে দেখেন। এই ধরেন শান্তিচুক্তির বর্ষপূর্তিতে বিভিন্ন কর্মসূচিতে লোকজন টাকা দেয়। এটাকে কি চাঁদাবাজি বলবেন?’
গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে সবখানে আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের অনেক ঘটনার কথাই শোনা যাবে। সরকারকে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বলেন, ‘চাঁদাবাজদের বেশির ভাগ কালেকটরই বাঙালি। ফলে পাহাড়ে বাঙালি-পাহাড়ি মিলেমিশে চাঁদাবাজি করছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন