দেশে মানব মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো স্ট্রোক। স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে হাজারে ১১ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত। অথচ উন্নত বিশ্বে স্ট্রোকে আক্রান্ত হাজারে ২ থেকে ৩ জন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ, যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলমসহ দেশের প্রখ্যাত নিউরোলজিস্টরা গত এক বছর ধরে দেশের আট জেলায় গবেষণা চালিয়ে এসব তথ্য পেয়েছেন।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, মহিলার চেয়ে পুরুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। তবে সর্বাধিক ঝুঁকিতে আছেন মাদকাসক্তরা। দেশে স্ট্রোকের জন্য ৫০ ভাগ দায়ী উচ্চ রক্তচাপ। দেশের ময়মনসিংহ জেলায় স্ট্রোকের হার সবচেয়ে বেশি। আর স্ট্রোকের ঝুঁকি সবচেয়ে কম রাজশাহীতে। দেশেই আছে স্ট্রোকের উন্নত চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা। আগামীকাল ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জানুন স্ট্রোকের লক্ষণ, মিনিটেই বাঁচিয়ে দিন বহু জীবন’।
অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ব্যায়াম করলে স্ট্রোক থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বছরে দুইবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাই উত্তম। তবে কমপক্ষে বছরে একবার শারীরিক পরীক্ষা করতেই হবে। আর স্ট্রোকে যেসব উপসর্গ দেখা দেয় সেগুলো জানতে হবে। একই কথা বলেন অধ্যাপক ডা. মো. বদরুল আলম।
পৃথিবীব্যাপী প্রতি বছর ১৩ মিলিয়ন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। আর তাই বিশ্বে মৃত্যুর দ্বিতীয় এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ততার প্রধান কারণ হলো স্ট্রোক। বিশ্বের জনসংখ্যার অন্তত প্রতি চার জনে একজন তাদের জীবদ্দশায় স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন। আর আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রতি বছর স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে। ষাটোর্ধ বয়সী স্ট্রোকের রোগী প্রায় সাতগুণ। এমন বাস্তবতায় প্রতি বছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালন করা হচ্ছে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে স্ট্রোক সম্পর্কে সচেতন করা।
স্ট্রোক কি, কাদের হয় ও করণীয়
স্ট্রোক হলো মানুষের মস্তিষ্কের রক্তনালীর এমন একটি রোগ যাতে হঠাৎ করে সেই রক্তনালী বন্ধ হয়ে অথবা ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কের একটা নির্দিষ্ট অংশের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যায়। ষাটোর্ধ বয়সে স্ট্রোকের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, মহিলাদের তুলনায় পুরুষের ঝুঁকি আরও বেশি। একবার স্ট্রোক হলে, ভবিষ্যতে সেই ঝুঁকি আরও বাড়ে। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ, ডায়াবেটিকস, রক্তের উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টোরেল, হার্টের অসুখ, ধূমপান, তামাকজাত ও নেশা জাতীয় দ্রব্যগ্রহণ, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং স্থূলকায় শরীর স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। স্ট্রোক হঠাৎ করেই হয়। কারও এটি ঘটার সাথে সাথে পরিবারের সদস্যরা যদি তা বুঝতে পারেন তাহলে দ্রুত সঠিক জায়গায় সঠিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারবেন। অর্থাৎ হঠাৎ করে যদি কেউ পড়ে যান, দৃষ্টিশক্তি চলে যায়, মুখ বেঁকে যায়, শরীরের এক পাশ দুর্বল বা অবশ হয়ে যায়, মুখের কথা জড়িয়ে যায় তাহলে বুঝবেন রোগীর হয়তো স্ট্রোক হয়ে থাকতে পারে। এছাড়া তীব্র মাথা ব্যথা (মাথায় বজ্রপাত হওয়ার মতো অনুভূতি), বমি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ থাকতে পারে।
এমন হলে সাথে সাথে রোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে স্ট্রোক হওয়ার ৩-৪.৫ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসকের কাছে আসলে যে সব হাসপাতালে স্ট্রোক ইউনিট বা স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু আছে, সেখানে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তবে সাধারণভাবে বাংলাদেশের সকল সরকারি হাসপাতালেই স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। এখানে উল্লেখ্য যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস বাংলাদেশের দূর দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রান্তিক চিকিৎসকদের স্ট্রোকের চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। বিশ্বময় স্ট্রোকের ভয়াল থাবা থেকে মানুষকে সচেতন করার প্রয়াস থেকেই প্রতি বছর ২৯ শে অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালন হয়ে আসছে।
স্ট্রোক চিকিৎসায় বাংলাদেশ
বিশ্বের যে কোন উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশ স্ট্রোক চিকিৎসায় পিছিয়ে নেই। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস এন্ড হাসপাতালে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অত্যাধুনিক ১০০ বেডের স্ট্রোক ইউনিট নিরবিচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এখানে, স্ট্রোকের রোগী ৩-৪.৫ ঘণ্টার মধ্যে আসলে আই ভি থ্রম্বোলাইসিস, ৮-১৬ ঘণ্টার মধ্যে আসলে মেকানিক্যাল থ্রম্বেকটমিসহ, এখানে ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজী বিভাগে এনজিওপ্লাষ্টি ও স্টেন্টিং, এন্ডোভাস্কুলার কয়লিং, অ্যাম্বোলাইজেশনসহ স্ট্রোকের সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু আছে। এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। এ ব্যবস্থায় মাথার খুলি না কেটেই রক্তনালীর মাধ্যমে স্ট্রোকের চিকিৎসা করা হয়। প্রয়োজনভেদে স্ট্রোকের সব ধরনের নিউরোসার্জিক্যাল চিকিৎসা আছে, যেমন ডি কম্প্রোসিভ ক্রেনিয়েকটমি, ক্লিপিং, থার্ডভেন্ট্রিকুলার ড্রেইনেজ ইত্যাদি। শুধু নিউরোসায়েন্স হাসপাতালেই প্রতি বছর প্রায় দশ হাজার স্ট্রোক রোগী আন্তঃবিভাগে চিকিৎসা নেন। এছাড়াও এখানে বিশেষায়িত স্ট্রোক বহিঃ বিভাগ ক্লিনিকেও প্রতি বছর কয়েক হাজার স্ট্রোকের রোগী চিকিৎসা পরামর্শ নেন।
স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে করণীয়
ওজন কমাতে সুষম খাবারের উপরেই ভরসা রাখুন। দামি নয়, দেশি ও সহজলভ্য খাবার দিয়ে থালা সাজান। ডায়েটে রাখুন পর্যাপ্ত পরিমাণে সবজি ও দেশি ফল। সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন আধা ঘণ্টা করে দ্রুত হাটতে হবে বা ২ দিন ১৫০ মিনিট জগিং করতে পারেন। ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। প্রতিদিন অন্তত ৬ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। ব্লাড প্রেশার আর সুগার বেশি থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রেখে চলতে হবে। শরীরচর্চার সময় খেয়াল রাখতে হবে তা যেন অত্যধিক পরিশ্রমসাধ্য বা ক্লান্তিকর না হয়।
গতকাল বুধবার (২৮ অক্টোবর) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক ডে-২০২১’ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভা ও বৈজ্ঞানিক সেমিনারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতি চার জনের মধ্যে এক জনের স্ট্রোক হয়। স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দেওয়ার চার ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে রোগীকে সুস্থ রাখা সম্ভব। স্ট্রোক হওয়ার জন্যে উচ্চ রক্তচাপ শতকরা ৫০ শতাংশ দায়ী। এরপরেই রয়েছে ৩৬ শতাংশের অনিয়মিত জীবনযাপন, ২৩ শতাংশের জাঙ্ক ফুডে আসক্তি এবং ১৭ শতাংশের মানসিক চাপ দায়ী। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, আমাদের দেশে ময়মনসিংহ বিভাগে স্ট্রোকের হার বেশি এবং সবচেয়ে কম রাজশাহীতে। বিশ্বব্যাপী স্ট্রোক বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে নিউরোসার্জারি বিভাগ এই সেমিনারের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক রাজিউল হকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা মেডিক্যালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক, বিশেষ অতিথি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ জহিরুল আলম। আরও বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ডা. দেবেশ চন্দ্র তালুকদার, সহযোগী অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম, ডা. আহমেদ হোসেন চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
ইত্তেফাক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন