কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা থামছেই না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে সেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই গোলাগুলি ও খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে। অন্তত ১৪টি সন্ত্রাসী এখানকার নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকা-ের এক মাস না পেরোতেই উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরে আবারও খুনের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শুক্রবার ভোরে স্থানীয় এক মাদরাসায় হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা ছয়জনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে। ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। এ ঘটনার পর ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের দুশ্চিন্তা ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল।
গতকাল ভোর ৪টার দিকে কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ময়নারঘোনা ১৮নং ক্যাম্পে ৫২ ব্লকে দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া মাদরাসায় ৬ জনের খুনের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় হামলাকারীদের একজন মুুজিবুর রহমানকে (১৭) অস্ত্রসহ আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সে ক্যাম্প-১১ এর ব্লক এ/২-এর আবুল কালামের ছেলে। তার কাছ থেকে একটি শুটারগান, ৬ রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরি উদ্ধার করা হয়।
নিহতরা হলেনÑ ক্যাম্প ১২-এর মাদরাসা শিক্ষক মো. ইদ্রিস, ক্যাম্প-৯ এর ইব্রাহীম হোসেন, ক্যাম্প-১৮ এর নুরুল ইসলামের ছেলে ও মাদরাসাছাত্র আজিজুল হক, ক্যাম্প-১৮ এর আবুল হোসেনের ছেলে মো. আমিন। ক্যাম্প-১৮ এর মোহাম্মদ নবীর ছেলে নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫), ক্যাম্প-২৪ এর মাদরাসাশিক্ষক রহিমুল্লাহর ছেলে হামিদুল্লাহ (৫৫) ও ক্যাম্প-১৮ এর নুর মোহাম্মদ এর ছেলে মাদরাসাছাত্র নুর কায়সার (১৫)।
পুলিশ জানিয়েছে, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা যখন তাহাজ্জত নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক সেই সময় হামলা হয়। দা দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় শিক্ষক-ছাত্রদের। হতাহতদের চিৎকারে আশপাশের রোহিঙ্গারা এগিয়ে এলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান ৪ জন। হাসপাতালে মৃত্যু হয় দুজনের। কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে কোনো ঘটনা ঘটানো হলে সেটি ঠেকানো কঠিন। যেহেতু আবার একটি ঘটনা ঘটে গেছে। সে ক্ষেত্রে এটা বলা যায় যে নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল।’
আব্দুর রশিদ আরও বলেন, ‘এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে কতগুলো গ্রুপ সক্রিয় এবং কী পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে, সে বিষয়গুলো দেখতে হবে। এছাড়া কোন কোন অপশক্তি মদদ দিচ্ছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। কৌশল বদলাতে হবে নিরাপত্তা বাহিনীকে। ধরাবাঁধা সিস্টেমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে বলে আমি মনে করি না।’
এদিকে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছেন না। যদি কেউ তাদের অপরাধ কর্মকা- নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেন কিংবা নাম প্রকাশ করেন, তা হলে তাদের রাতের আঁধারে হত্যা করা হবে বলে জানিয়েছেন খোদ নিহতদের একজনের ছোট ভাই।
উখিয়া থানার ওসি আহাম্মদ মনজুর মোর্শেদ জানিয়েছেন, ময়নাতদন্তের জন্য লাশ কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন কক্সবাজার ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার শামছুদ্দৌজা নয়ন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ ও অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম।
এপিবিএন এর এক বার্তায় হামলাকারীদের বর্ণনা করা হয়েছে ‘রোহিঙ্গা দুষ্কৃতকারী’ হিসেবে। ৮ এপিবিএন এসপি মো. শিহাব কায়সার খান বলেন, শুক্রবার ভোরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে ৬ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। জড়িত থাকার অভিযোগে একজনকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনার পর ক্যাম্পজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ক্যাম্পের পরিস্থিতি এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ক্যাম্প এলাকায় ব্লকরেইড পরিচালনা করা হয়েছে।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান জানিয়েছেন, মামলার প্রক্রিয়া চলছে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ধরতে ক্যাম্পে এপিবিএন ও জেলা পুলিশের যৌথ অভিযান চলছে। স্থানীয়ভাবে পাওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওই মাদরাসার মেঝেতে রক্ত ছড়িয়ে আছে। নিহতদের স্বজনরা বিলাপ করছেন।
বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে গত চার বছরে অন্তত ১০৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। নিহত ১০৮ জনের মধ্যে ৭৮ জনকে অতর্কিতভাবে দুর্বৃত্তরা খুন করেছে। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে প্রাণ হারান ২২ জন। অপহরণের পর হত্যা করা হয় দুজনকে। এ ছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় খুন হন আরও ৬ জন।
কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তত ১৪টি সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয়। এর মধ্যে টেকনাফে ৭টি ও উখিয়ায় ৭টি। টেকনাফে রয়েছে হাকিম বাহিনী, সাদেক বাহিনী, হাসান বাহিনী, নুরুল আলম বাহিনী, হামিদ বাহিনী ও নুর মোহাম্মদ বাহিনী। উখিয়ায় রয়েছে মুন্না বাহিনী, আসাদ বাহিনী, রহিম বাহিনী, কামাল বাহিনী, জামাল বাহিনী, মনু বাহিনী ও গিয়াস বাহিনী। এসব বাহিনী কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবির ঘিরে ইয়াবা ও স্বর্ণ চোরাচালান, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মানবপাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে প্রায়ই পাল্টাপাল্টি হামলা ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কুতুপালং-১ (ইস্ট) লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-৮ ব্লকে গুলি করে হত্যা করা হয় মুহিবুল্লাহকে, যিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামের একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার পরিবারের অভিযোগ, প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করা মুহিবুল্লাহকে রোহিঙ্গাদের আরেকটি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) হত্যা করেছে। মুহিবুল্লাহ হত্যাকা-ের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ‘অস্থিরতা’ তৈরির চেষ্টায় মিয়ানমার থেকে বিভিন্নভাবে অস্ত্র আসছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, ক্যাম্পের ভেতরে একটি অংশ আছে, যাদের ‘কাফের’ বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে সন্দেহ করে অপরপক্ষ। এসব ব্যক্তি এখনো ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের তথ্য দেয় বলে তাদের প্রতিপক্ষের অভিযোগ।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সূত্রগুলো বলছে, ক্যাম্পের ভেতরে তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠীর কথা না শুনলে পরিণতি হয় ভয়াবহ। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্যাম্পের ভেতরে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। স্থানীয়রা বলেছেন, ক্যাম্পের ভেতরে একটা কথা প্রচলিত আছে, ক্যাম্প দিনের বেলায় বাংলাদেশের আর রাতের বেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর। এটা এখন ওপেন সিক্রেট। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে, মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যা সমাধান করা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন