বেলায়েত হুসাইন
আজ পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসের ১২তম দিন। বিশেষত দুটি কারণে ইসলামি ইতিহাসে মাসটি তাৎপর্যমণ্ডিত। একটি বেশ আনন্দের, অন্যটি সীমাহীন দুঃখ ও বেদনার।
যে কারণে আনন্দের
প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। আগের সকল আসমানি কিতাবে তার জন্ম প্রতিশ্রুত ছিল। সব যুগে আল্লাহর বান্দারা তার আগমনের প্রতীক্ষা করছিল। এজন্য দিনটি তার জন্মের আগে ও পরে সবসময় উম্মাহর কাছে সবচেয়ে আগ্রহ ও আনন্দের মুহূর্ত।
দুঃখের যে কারণে
হিজরি একাদশ সন। রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ। কিন্তু ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের মতো দিনটি আনন্দের নয়। ছিল দুঃখ ও বেদনার। এদিন রাসুল (সা.) মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, প্রায় দেড় হাজার বছর পরও সমানভাবে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে মুসলমানরা। কেয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।
তাঁর জন্মদিনের বিস্ময়কর কিছু ঘটনা
মহানবী (সা.)-এর জন্মে গোটা দুনিয়ায় আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। দেখা দিয়েছিল বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার। সাধারণ সৃষ্টিকূলের মাঝেও তার জন্ম-নির্দশন পরিলক্ষিত হয়েছে।
জন্মের পরপরই সেজদা দেন হযরত মোহাম্মদ (সা.)। সেজদা থেকে উঠে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করেন। তখন পুরো গৃহ আলোকময় হয়ে ওঠে। হজরত মা আমেনা বলেন, ‘আমি ওই আলোতে ইরান, সিরিয়া ও হীরার রাজপ্রাসাদ দেখতে পেলাম।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)।
তাঁর জন্মের সময় আরও কিছু বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করেছেন মা আমেনার সেবিকা শিফা বিনতে আসওয়াদ (রা.)। তার বর্ণনা অনুযায়ী-মহানবী (সা.) যখন দুনিয়ায় আসেন তখন তার গোটা জন্মকক্ষ আলোকিত হয়েছিল। সদ্যভূমিষ্ট সাধারণ শিশুর মতো তার শরীরে কোনও ময়লা-আবর্জনা ছিল না। নাভি কর্তিত অবস্থায় এবং খৎনাকৃত হয়ে তাঁর জন্ম হয়েছিল।
এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে— রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ আমার প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করেছেন তার অন্যতম হলো, আমি খৎনাবিশিষ্ট হয়ে ভূমিষ্ট হয়েছি। যাতে আমার লজ্জাস্থান কেউ না দেখে।’ (মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৬১৪৮)
ইন্তেকালের আগে তাঁর অমূল্য উপদেশ
রাসুল (সা.)-এর জীবন সায়াহ্নে তাঁর কাছে সাহাবারা একত্রিত হন। তখন তিনি সবার জন্য দোয়া করেন এবং বলেন, আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জনের। আর অহংকারী হয়ো না। ইহুদি-খ্রিস্টানদের ওপর আল্লাহর লানত। তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে সিজদার জায়গা বানিয়েছে। তাদের মতো আমার ইন্তেকালের পর তোমরা আমার কবরকে সিজদার স্থান (সেজদা দিও না) বানিয়ো না। (সহিহ বুখারি) ইন্তেকালের কিছুক্ষণ পূর্বে সাহাবাদের বলেন, তোমরা নামাজের ব্যাপারে যত্নশীল হও। তোমাদের অধীনস্তদের সঙ্গে দয়া ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করো। (আবু দাউদ)।
ইন্তেকাল পূর্ববর্তী সবশেষ গণজমায়েতে তিনি যে ভাষণ (বিদায় হজের ভাষণ) দিয়েছিলেন, তা এখনও সর্বোৎকৃষ্ট উপদেশ হিসেবে স্বীকৃত।
প্রসঙ্গ ঈদে মিলাদুন্নবি
আমাদের সমাজের এক শ্রেণির লোক ১২ রবিউল আওয়ালের দিন ‘ঈদে মিলাদুন্নবি’ (রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনের ঈদ) পালন করেন। একইসঙ্গে তারা এটাও দাবি করেন, এই ঈদ ‘সাইয়্যেদুল আইয়াদ’ তথা সকল ঈদের বড় ঈদ। অথচ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ‘জুমহুর’ বা অধিকাংশ আলেম এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অভিমত হলো-মিলাদুন্নবি (নবীর জন্ম) উপলক্ষে কোনও ঈদ নেই। ইসলামে মাত্র দুটি ঈদ।
এক হাদিসে নবীজী বলেন, প্রত্যেক জাতির উৎসব আছে, আমাদের উৎসব হলো এই দুই ঈদ (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা)।’ (মুসলিম, তিরমিজি)।
ঈদের দিনগুলোতে রোজা রাখা হারাম। অথচ রাসুল (সা.) তাঁর জন্মদিন সোমবারে রোজা রাখতেন। আনসারি সাহাবি হজরত আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.)-এর নিকট সোমবার রোজা রাখা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ওই দিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি। ওই দিনই নবুয়ত লাভ করেছি।’ (মুসলিম, হাদিস নং : ১১৬২)। এখানে আমরা দেখি-আল্লাহর রাসুল (সা.) জন্ম তারিখ নয়; বরং জন্মবার (সোমবার) পালন করতেন।
মরহুম ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ইসলামের প্রথম ছয় শ’ বছরে ঈদে মিলাদুন্নবির অস্তিত্বই ছিল না। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, প্রসিদ্ধ চার ইমাম, বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানি, ইমাম গাজালিসহ তাদের কেউ ঈদে মিলাদুন্নবি পালন করেননি। তারা সারা বছর রাসুলের সিরাত তথা জীবনী নিয়ে আলোচনা করতেন। আমাদেরও তাই করা উচিত এবং রাসুলের অনুসরণে সোমবার রোজা রাখা উত্তম হবে।
এ বিষয়ে বিশ্বনন্দিত ইসলামি শিক্ষালয় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের ৩৭ হাজার ২নং ফতোয়ায় বলা হয়েছে-‘নবী কারিম (সা.) থেকে শুরু করে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, ইমামগণ, বুজুর্গানেদিন-এদের কারও থেকেই প্রচলিত জন্মদিন পালনের কোনও স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। জন্মদিন পালনের এ পদ্ধতি বিজাতীয়দের। মুসলমানদের জন্য জায়েজ নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও ধর্ম অনুসরণ করে, তা গ্রহণ করা হবে না আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫)।’
মিলাদুন্নবি সম্পর্কে বর্তমান বিশ্বের বরেণ্য ইসলামি স্কলার মৌরতানিয়ার বিশিষ্ট আলেম শায়খ মুহাম্মাদ ওয়ালিদুদ দাদো শানকিতি খুবই ভারসাম্যপূর্ণ একটি মত দিয়েছেন। যেহেতু রবিউল আওয়ালে রাসুল (সা.)-এর জন্ম ও মৃত্যু দুটোই হয়েছে। তাই তিনি বলেছেন, ‘যে একথা বিশ্বাস করবে যে, রাসুলের জন্মদিন ঈদ, সে বিদআত করলো। আর যে তাঁর মৃত্যুদিনে আনন্দিত হলো, সে কুফরি করলো। তবে জন্মদিন উপলক্ষে যদি কেউ এমন আনন্দিত হয় যেমনটা ফেরাউন থেকে মুসা (আ.)-এর মুক্তির দিনে আনন্দিত হয়েছিল, তাতে কোনও সমস্যা নেই। বরং এটি আল্লাহর রাসুলের প্রতি সম্মান জানানো হলো।’
তথ্যসূত্র: সীরাতে মুস্তফা, আর রাহিকুল মাখতুম, দেওবন্দের ওয়েবসাইট এবং শায়খ মুহাম্মাদ ওয়ালিদুদ দাদো শানকিতির প্রবন্ধ।
লেখক: শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ ঢাকা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন