ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সাবেক আইনমন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, পুলিশের সাবেক আইজি এ কে এম শহীদুল হক, মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম ও পূজা উদযাপন পরিষদের সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি
দুর্গাপূজায় কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার অভিযোগে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশে আবার কলঙ্কের দাগ লেগেছে। ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে গুজব তুলে বারবার সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা রাষ্ট্রের মৌলিক চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যে আঘাত ও বিশ্ব দরবারে সুনাম নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, বিচারহীনতার কারণেই এ ধরনের হামলা। এভাবে সম্প্রীতি নষ্ট হলে ধ্বংস হবে দেশ। হামলা বন্ধে দলমত নির্বিশেষ সব মহল থেকে কঠোর আইন করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি তোলা হয়েছে।
এ ঘটনাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ
সাবেক আইনমন্ত্রী
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের ওপর হামলাকে অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, স্বাধীন দেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণের বিভেদ থাকার কথা নয়। এ জন্য দেশ স্বাধীন করা হয়নি। কাজেই কোনো অবস্থাতেই এ ঘটনাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। গতকাল
আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘সঠিক তদন্ত করে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যারা এটা করছে, তাদের যদি ছেড়ে দেওয়া হয়, তা হলে ভবিষ্যতে তারা আবার এ কাজ করবে। তাদের দৃষ্টান্তশূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের ধরতে যা যা করণীয়, সবই করতে হবে। নয়তো অন্যরাও এমন কাজে উৎসাহ পাবে।’
হামলা বন্ধে কঠোর আইন দরকার
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তার মতে, এ ধরনের সহিংসতা রোধের মূল দায়িত্ব সরকারের। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তিনি মনে করেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতন
বন্ধের ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতন প্রসঙ্গটাই আমাদের জন্য লজ্জার। আগেও সংখ্যালঘুদের ওপর অনেক হামলা হয়েছে। কোনো হামলারই সঠিক বিচার হয়নি। এ বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এখন আবার হামলা হচ্ছে।’
সাম্প্রদায়িক হামলার বিষয়ে আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, ‘এসব হামলার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। যারা হামলা করছে, তারা আসলে ধর্মান্ধ। আর একটি গোষ্ঠী তাদের উসকানি দিচ্ছে। কোরআন অবমাননার অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই হামলা করছে। আসলে কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে না জেনেই হামলা করে বসছে। আরেকটা দিক হলো, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই একটা গোষ্ঠী আছে, যারা সে সময়েও স্বাধীনতার বিরোধী ছিল, তারা এখনো দেশবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে। তারা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। তারা কখনো এ দেশের ভালো চায়নি। তারা সব সময় সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশের সব উন্নয়নকাজেরও বিরোধিতা করে এবং বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক বিষয় সম্পর্কে গুজব ছড়িয়ে হামলা চালায়। এদের সঠিক বিচার করা গেলে ভবিষ্যতে এমন হামলা করার সাহস দেখাত না। সবাই যদি ঐক্যবদ্ধভাবে এ অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তা হলে এ সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ করা সম্ভব।’
এটি রোধ করতে প্রো-অ্যাক্টিভ পুলিশিং জরুরি
এ কে এম শহীদুল হক
পুলিশের সাবেক আইজি
আমার সময় জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করেছি। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, গ্রাম, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে কমিটি করেছি। যারা এলাকার ভালো মানুষ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে, কমিটিতে তাদের রেখেছি। ওই কমিটি ফাংশনাল থাকলে, তাদের মূল্যায়ন করা হলে তারা কিন্তু কাজ করতে উৎসাহ পান। তারা এ ধরনের
সংকটকালে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণ একটি মহল্লার আনাচে-কানাচে কী হচ্ছে এটা কিন্তু তারা সবচেয়ে ভালো জানেন। মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে এ ধরনের সংকটে পুলিশ একা কোনো কাজ করতে পারবে না। কাজেই এ ক্ষেত্রে এই ‘প্রো অ্যাক্টিভ পুলিশিংটা’ অতি জরুরি।
দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মোকাবিলায় পুলিশের করণীয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে এসব মন্তব্য করেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক। গতকাল আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার গোপনে কাজ করে দেখতে হবে, কারা এসব ষড়যন্ত্র করছে। সেটি বের করতে হবে। সন্দেহভাজনদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’
পুলিশের সাবেক এ শীর্ষ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গুজব রোধে ব্যাপক সচেতনতা কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত। মসজিদের ইমামদের দিয়ে বলাতে হবে। ইসলামের শিক্ষা তাদের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তাদের কথা মানুষ শোনে।’
মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হচ্ছে
নাছিমা বেগম
চেয়ারম্যান, মানবাধিকার কমিশন
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেছেন, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা নয়। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। গতকাল মঙ্গলবার আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশ হলো অসাম্প্রদায়িক একটা জায়গা। এখানে যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে, যারা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প
রোপণ করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে, তারা মানবতাবিরোধী কাজ করছে; মানবতার চরম লঙ্ঘন করছে। যে বা যারাই যে উদ্দেশ্যেই করুক, এটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, মেনে নেওয়া হবে না।’
নাছিমা বেগম আরও বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ দিয়েছি, এ ঘটনাগুলোয় যারা প্রকৃত দোষী যারা, তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হয়। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর এবং আরও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ ধরনের ঘটনার আর কখনই যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’
হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা পরিকল্পিত
নির্মল কুমার চ্যাটার্জি
সম্পাদক, পূজা উদযাপন পরিষদ
দেশের বিভিন্ন এলাকায় মন্দির-মণ্ডপ ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনাকে পরিকল্পিত উল্লেখ করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলেছেন, ‘ওরা পরিকল্পিতভাবে ইসকনের ওপর আঘাত করছে, যাদের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক রয়েছে, ওরা হিট করছে রামকৃষ্ণ মিশনে, যারা বিশ্বব্যাপী সব ধর্মকে
আপহোল্ড (ধারণ) করে। নোয়াখালীতে রাম ঠাকুর মন্দিরে হামলা করেছে, যেখানে ৪৬ সালে দাঙ্গার ৭৫ বছর পর হামলা হয়েছে। এ রাম ঠাকুর মন্দিরের ব্যাপক অনুসারী রয়েছে ভারতে। ওরা শুধু মন্দিরকে টার্গেট করে ধ্বংস করছে না, ওরা পরিকল্পিতভাবে দেশটাকে ধ্বংস করছে।’
আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘সরকারকে আমরা আগেই বলেছি, প্রশাসনের একার পক্ষে এ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কারণ সংঘবদ্ধভাবে, পরিকল্পিতভাবে চার-পাঁচ হাজার মানুষ হঠাৎ করেই বাড়িঘরে আক্রমণ করছে। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কী করার থাকে? সে কারণে সরকারকে আমরা বলছি, আপনার দল নামান। দলকে বলছি, আপনারা যারা দলের নেতাকর্মী, তারা তো ১২ বছর ধরে অনেকেই দলে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। এখন ক্লান্ত হলে চলবে না। বঙ্গবন্ধু কন্যার আলোয় যারা আলোকিত, তাদের স্ট্যান্ড নিতে হবে এ পরিস্থিতি রুখতে। তারা টার্গেট করে বঙ্গবন্ধু কন্যার ওপর হিট করছে।’
দেশের প্রতি যাদের মমত্ববোধ আছে, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে তাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশে এসে দাঁড়ানোর এবং অপশক্তিকে রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, ‘নইলে দেশটা কেন ধ্বংস হয়ে গেল সে ব্যাপারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জবাব দিতে হবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন