খুলানার জাহিদ শেখের বর্তমান বয়স ৪৮ বছর। স্ত্রী ও এক সন্তান হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে ২০ বছর ছিলেন কারাগারের কনডেম সেলে (নির্জন প্রকোষ্ঠে)। অবশেষে চূড়ান্ত বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হলে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ তাকে খালাস দেন। কারাগার থেকে মুক্তির পর জাহিদ জানালেন কনডেম সেলের দুর্বিষহ জীবনের কথা। যে কোনো সময় ফাঁসির মঞ্চে যেতে হবে-এমন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটত তার। দীর্ঘ এ সময় পাশাপাশি থাকা অনেকের ফাঁসিও দেখেছেন। তিনি বলেন, কখনো ভাবিনি ছাড়া পাব। আমি নির্দোষ ছিলাম। কারাগারে ২০ বছর অনেক কষ্টে কেটেছে। আমার এখন কেউ নেই, কিছু নেই। জেলে থাকা অবস্থায় মা-বাবাকে হারিয়েছি। নিজের বাড়ির সম্পত্তি বলতে যা ছিল, মামলার খরচ চালাতেই চলে গেছে।
সম্প্রতি এমন বেশকিছু পুরোনো মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বিচার শেষে আপিল বিভাগ খালাস দিয়েছেন। কাউকে দিয়েছেন যাবজ্জীবন, আবার কারও মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন। তবে হাইকোর্টে বেশকিছু ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক নিরপরাধ আসামি বছরের পর বছর কারাগারের কনডেম সেলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এদিকে তিনজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সম্প্রতি রিট দায়ের করেছেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কারাবন্দি ও কনডেম সেলের সংখ্যা, কারাগারের সংস্কার, ব্যবস্থাপনা, কনডেম সেলের সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত প্রতিবেদন চেয়েছেন।
জানা যায়, বিচারিক আদালত কোনো আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলে সেটিকে কার্যকর করতে অনুমোদন লাগে হাইকোর্টের। এটিকেই ডেথ রেফারেন্স বা মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন বলা হয়। হাইকোর্টের রায়ের পর সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করতে পারে। আর আপিলে আসা সিদ্ধান্তের পর তা পুনর্বিবেচনা চেয়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষের আবেদনও করার সুযোগ আছে। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে পেপারবুক তৈরি করতে হয়, যেখানে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের বক্তব্য, বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার তথ্যাদি সন্নিবেশিত থাকে।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা বাড়ছেই। প্রতিবছর যতসংখ্যক ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে, এর অর্ধেকও নিষ্পত্তি হয় না। ফলে দিনদিন এর সংখ্যা বাড়ছে। করোনা, আদালতের বার্ষিক ছুটি এবং বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ ভাঙার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে ভাটা পড়ে যায়। বর্তমানে হাইকোর্টে আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, হলি আর্টিজান হামলা, নুসরাত হত্যা, রিফাত শরিফ হত্যা মামলাসহ বেশকিছু আলোচিত মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় আছে। এছাড়া আপিল বিভাগে চাঞ্চল্যকর নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ হত্যা ও পিলখানা হত্যাসহ শতাধিক আপিল রয়েছে শুনানির অপেক্ষায়।
সুপ্রিমকোর্টের তথ্য অনুযায়ী, গত সাত বছরে ৯৬৯টি ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্টে আসে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১২৬টি। এখন শুনানির অপেক্ষায় আছে ৮৪৩টি মামলা। এসব মামলায় সারা দেশে ৬৮ কারাগারের কনডেম সেলে বন্দি (১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ২ হাজার ১৫৩ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন, যা গত বছর ছিল দুই হাজারের নিচে। বর্তমানে ২ হাজার ১৫৩ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে আসে ১১৪টি মামলায় ২৩০ জন, ২০১৬ সালে ১৬১টি মামলায় ৩৩৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭১টি মামলায় ৩৯১ জন, ২০১৮ সালে ১৫৪টি মামলায় ৩৯৮ জন, ২০১৯ সালে ১৬৪টি মামলায় ৩৭০ জন, ২০২০ সালে ১২৩টি মামলায় ২৫৪ জন এবং ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮২টি মামলায় ১৭৫ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন। যারা বর্তমানে কারাগারের কনডেম সেলে আছেন। হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি চলছে। সে হিসাবে চলতি বছর যেসব আসামি নিু আদালতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছেন, তাদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হবে ২০২৬ সালে। ফলে একজন ফাঁসির আসামিকে হাইকোর্টে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। আর হাইকোর্ট যদি কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন, তাহলে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে তাকে।
ডেথ রেফারেন্স জট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। এসবের নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত পেপারবুক তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, বর্তমানে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে চাঞ্চল্যকর বেশকিছু মামলা শুনানির অপেক্ষায় আছে। এসবের শুনানি হওয়া জরুরি। তিনি বলেন, ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করতে হলে কোনো রকম মুলতুবি না দিয়ে শুনানি অব্যাহত রাখতে হবে। বেঞ্চ বাড়ানোর পাশাপাশি বিচারক নিয়োগেরও প্রয়োজন রয়েছে। বিচার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কনডেম সেলে থাকা ঠিক না বলেও মনে করেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাগেরহাটের আদালত ২০০০ সালের ২৫ জুন এক রায়ে একমাত্র আসামি খুলনার জাহিদ শেখকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায় ঘোষণার আগে জাহিদ আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। নিু আদালতের রায় অনুমোদনের জন্য উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। চার বছর পর হাইকোর্টে শুনানি হয়। এরপর ২০০৪ সালের ৩১ জুলাই সেখানেও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে কারাগার থেকে ২০০৭ সালে আপিল বিভাগে জেল আপিল করেন জাহিদ। এতদিন মামলাটি ওই বিভাগেই পড়ে ছিল। মামলাটি নজরে পড়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চের। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন সর্বোচ্চ আদালত। নিযুক্ত করা হয় জাহিদের আইনজীবী। কিন্তু মামলার শুনানি করতে গিয়ে আপিল বিভাগ দেখেন নানা অসংগতি। বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরলে দীর্ঘ শুনানি শেষে গত বছরের ২৫ আগস্ট আপিল বিভাগ জাহিদকে খালাস দেন। বিনা দোষে ২০ বছর কারাভোগ করে অবশেষে মুক্তি পান জাহিদ শেখ।
সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত বিচারের আগে কনডেম সেলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের রাখার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রাখেন জাহিদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বিচারের তিনটি ধাপ রয়েছে। বিচারিক আদালত, উচ্চ আদালত ও সর্বোচ্চ আদালত (আপিল বিভাগ)। বিচারিক আদালত যেহেতু চূড়ান্ত বিচার নয়, সেহেতু একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে রাখার যৌক্তিকতা কি আছে। মৃত্যুদণ্ডের একটা মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে ২০ বছর সময় লেগেছে।
কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তিন আসামি সম্প্রতি একটি রিট করেন। তাদের আইনজীবী শিশির মনিরের দাবি, যেহেতু মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়, সে কারণে আগেভাগেই কনডেম সেলে রাখা ঠিক হবে না। আপিল ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার পরই এ সেলে রাখা যেতে পারে। এর আগ পর্যন্ত তাদের জন্য কারাগারে বিশেষ ব্যবস্থায় অন্য আসামিদের সঙ্গে রাখতে হবে। তিনি বলেন, একটি মৃত্যুদণ্ড মামলার শুনানি করতে সময় লাগে হাইকোর্টে ছয় বছর আর আপিলে লাগে ছয় থেকে ১০ বছর। অ্যাভারেজে ১০, ১২, ১৪ এমনকি ১৮ বছরও। এমনও দেখা যায়, আপিল বিভাগ থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে অনেককে। তারা ২০ বছরের অধিক সময় কনডেম সেলে ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেল সুপার যুগান্তরকে বলেন, কনডেম সেল বলতে কারাগারে কোনো সেল নেই। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও দুর্র্ধর্ষ আসামিদের একটি বিশেষ সেলে রাখা হয়। সার্বক্ষণিক তাদের মনিটরিং করা হয়।
জানতে চাইলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ডেথ রেফারেন্স জটের অন্যতম কারণ হলো বিচারিক আদালতে ঢালাওভাবে ফাঁসির আদেশ। হাইকোর্টে ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ বিচারকের সংকট রয়েছে। অনেক বিচারক আছেন ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনতে চান না। তিনি বলেন, মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেক নির্দোষ ব্যক্তিকে বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। অনেক সময় নির্দোষ ব্যক্তির বিচারিক আদালতে সাজা হয়। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে।
সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আলী আকবর যুগান্তরকে বলেন, এ বছর আপিল বিভাগে বেশকিছু পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। হাইকোর্টেও ডেথ রেফারেন্স শুনানি হচ্ছে। করোনার কারণে কিছুটা প্রভাব পড়েছিল। এখন সেই অবস্থা নেই। আশা করছি, মামলাজট থাকবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন