‘আমার ছেলে তো ছোট মানুষ, তোমরা বড় বড় মানুষ। আমার ছেলে না হয় ইফতার-সেহরির জন্য কিছু সময় দাবি করছিল। তোমরা সম্ভব হলে দিতা, না হলে দিতা না। কিন্তু এভাবে আমার ছেলেটার বুকে কেমনে গুলি চালাতে পারলা?’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে এভাবেই গুলিবিদ্ধ ছেলে মোরশেদের পাশে বসে আহাজারি করছিলেন তার মা। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মোরশেদের বড় ভাই মো. ফারুক।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে শনিবার (১৭ এপ্রিল) দুপুরে শ্রমিকদের বিক্ষোভে গুলির ঘটনায় আহত হয়েছেন মোরশেদ। ওই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন।
গুলিবিদ্ধ শ্রমিকদের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) ইফতার এবং সেহরির জন্য কিছু সময় বরাদ্দ (বিরতি) ও কর্মঘণ্টা কমানোর দাবিতে আন্দোলন করেন শ্রমিকরা। আজ শনিবার তাদের কিছু দাবি মানার কথা ছিল। দাবি মানলে শ্রমিকরা কাজে ফেরার কথা ছিল।
এই দাবি নিয়েই সকালে জড়ো হন শ্রমিকরা। তবে কর্তৃপক্ষ ‘কোনো দাবি মানা হবে না’ বলে জানালে উত্তেজিত হয়ে পড়েন শ্রমিকরা। পরে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ পুলিশকে খবর দেয়।
কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। উত্তেজনার এক পর্যায়ে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে চালানো হয় গুলি। সংঘর্ষে পাঁচ শ্রমিক নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক।
এদের মধ্যে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চারজনের মরদেহ রয়েছে। তারা হলেন- শুভ (২৩), মো. রাহাত (২৪), আহমদ রেজা (১৯) ও রনি হোসেন (২২)।
গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত কয়েকজনকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক হাবিবুল্লাহ (১৯) নামে আরেক শ্রমিককে মৃত ঘোষণা করেন। বাকিদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
আহতদের সঙ্গে চমেক হাসপাতালে আসা গন্ডামারা ইউনিয়নের বাসিন্দা তৌহিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিক আছে ১০ হাজারের মতো। তারা গতকাল ইফতার-সেহরির সময় কাজ বন্ধ ও কর্মঘণ্টা কমানোর দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন। দাবি মানার কথাও ছিল। কিন্তু আজকে পুলিশ গুলি চালালে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবে আন্দোলনে বেতন বাড়ানোর কোনো দাবি ছিল না।’
পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, এ ঘটনায় ইয়াসির (২৪), আহমদ কবির (২৬) ও আসাদুজ্জামান (২৩) নামে তিনজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক কানিজ ফাতেমা রুম্পা জাগো নিউজকে বলেন, ‘গন্ডামারা এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনের মরদেহ হাসপাতালে আছে। আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’
চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) শীলব্রত বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাঁশখালী এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ শ্রমিককে হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে একজনকে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া একই ঘটনায় আহত তিন পুলিশ কনস্টেবলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত কর্তৃপক্ষ থেকে জেনে নিন। শ্রমিকরা পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে, তাই পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ কখনো আগে গুলি করে না। এরপরও নিহতের স্বজনরা যদি অভিযোগ করে থাকেন, তবে পুলিশ কেন গুলি চালিয়েছে তা তদন্ত করা হবে।’
এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সময়ও স্থানীয়দের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ লোকজনের সংঘর্ষ বাধে। ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিলের ওই সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছিলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন