ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে কুইক রেসপন্স টিম ও হটলাইন নম্বর চালু করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। হটলাইন চালুর তিন মাস হতে চললেও সেভাবে সেবা দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি এই কুইক রেসপন্স টিমের। পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) কর্মকর্তারা বলছেন, নম্বরটির বিষয়ে প্রচার না হওয়ায় মূল এজেন্ডা নিয়ে সেবা দেওয়ার সুযোগ কম মিলেছে। তবে এখন পর্যন্ত তারা যেসব সেবা দিয়েছেন, তার অধিকাংশই পারিবারিক কোন্দল নিয়ে। স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগই বেশি।
উইমেন সাপোর্ট সেন্টারের সহকারী পুলিশ কমিশনার মিনা মাহমুদা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছর ২৭ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে এই হটলাইন ০১৩২০০৪২০৫৫ নম্বর চালু হয়। এরপর থেকে প্রতিদিন আমরা একটা-দুটা করে ফোন কল পাচ্ছি। তবে এই ফোন কলগুলো অধিংকাশই পারিবারিক বনিবনা না হওয়া নিয়ে। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া বিবাদের পরে ভিকটিম স্ত্রী ফোন করছেন। আবার কখনও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ফোন করছেন। এমন প্রায় শতাধিক ফোন আমরা পেয়েছি। আমরা ২৪ ঘণ্টাই প্রস্তুত থাকি। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে যেকোনও ডাকে সাড়া দিতে চেষ্টা করি।’
তিনি জানান, অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ফোন ১০২টি কল পেয়েছেন তারা। এর বেশিরভাগই স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীদের অভিযোগ।
পুলিশের এই সহকারী কমিশনার আরও বলেন, ‘আমরা সব ভিকটিমের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। যদি মোবাইল ফোনে সমাধানযোগ্য হয় তাহলে সেটা করছি। না হলে সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দিয়েছি । আমাদের পক্ষ থেকে থানায় কথা বলছি। নানাভাবে ভিকটিমকে সর্বোচ্চ সাহায্য করছি। তবে এখনও এই হটলাইন নম্বরটি খুব প্রচার পায়নি। হটলাইন নম্বরটির প্রচার প্রয়োজন। পরিচিতি পেলে আমরা আরও বেশি ভুক্তভোগীকে সাহায্য করতে পারবো। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবো।’
মানবধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সারাদেশে এক হাজার ৬২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর মারা গেছেন ৫৩ জন। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। একই বছর সারাদেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছে এক হাজার ৭১৮ জন শিশু। এর মধ্যে মামলা হয়েছে ৯৮৬টি।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সামাজিক অপরাধগুলো সরাসরি প্রতিরোধ করা একটু কঠিন। এজন্য কুইক রেসপন্স টিম গঠন ও হটলাইন চালু করা হয়েছে। নারীরা রাস্তায় বা অন্য কোথাও অনিরাপদ বোধ করলে বা বিপদে পড়লে এসব টিমের হটলাইনে যোগাযোগ করে তাৎক্ষণিক সাহায্য নিতে পারবেন। নারীদের সমস্যা শুনতে ও সামাজিক নির্যাতন প্রতিরোধ করতে একটি বিশেষ টিমের প্রয়োজন অনুধাবন করেই কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। বিপদাপন্ন নারীকে সহায়তা দিতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এ টিম।
উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) উপ-পুলিশ কমিশনার হামিদা পারভিন বলেন, ‘২০০৯ সালে এই সেন্টারটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজারের বেশি নারীকে সেন্টারে রেখে সেবা দিয়েছি আমরা। ২০১১ সাল থেকে মামলার তদন্ত নিয়ে কাজ করার অনুমতি পায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। ইতোমধ্যে তিন হাজার ৬০০টি মামলা তদন্ত করেছি। এরমধ্যে তিন হাজার ৩০০ মামলার চার্জশিটও দিয়েছি। এখানে থাকা অবস্থায় ভিকটিমদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও আমরা কাজ করছি।’
সর্বশেষ আজিমপুরে বয়স না হতেই বিয়ে দেওয়ায় নিজ থেকে তালাক নেওয়া কিশোরী দুই দিন এই সেফ হোমে (উইমেন সাপোর্ট সেন্টার) ছিল। শনিবার (২৩ জানুয়ারি) দুপুরে সেফ হোম থেকে থানা পুলিশের মাধ্যমে আদালতে পাঠানো হয় মেয়েটিকে। পরবর্তীতে আদালত তার পরিবার ডেকে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
উপ-পুলিশ কমিশনার হামিদা পারভিন বলেন, ‘আমরা মনে করি, এই কাজটিও আমরা ঠিকভাবে করতে পারবো। বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারবো। এই হটলাইন ও টিমটি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে।’
ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই না কোনও নারী অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখিন হোন। তাদের কথা শোনার জন্য আমাদের এই প্রচেষ্টা। আমরা টিমটাকে এমনভাবে তৈরি করবো, যেখানে যেকোনও মেয়ে বা বোন তার খারাপ লাগার জায়গাটা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। এখানে সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি থাকবে। পরবর্তীতে আরও গাড়ি যোগ হবে। ৯৯৯-এর মতো যেন আমাদের একটা শক্ত টিম হয় বা দ্রুত রেসপন্স করতে পারে সেই আশা নিয়ে কাজ করছি।’
পুলিশ সদস্যদের মানবিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘থানায় ভুক্তভোগী এলে কীভাবে মানবিক সহায়তা দিতে হবে, তা পুলিশ সদস্যদের শেখানো হচ্ছে। প্রতিটি থানায় নারী ও শিশু সহায়তা ডেস্ক রাখা হয়েছে, যেখানে নারী কর্মকর্তাদের পদায়ন করার চেষ্টা চলছে। আমরা এই টিমের ৩০ জন নারীকে সেভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করছি। যেন তারাও মাঠে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে পারেন।’
প্রচারণার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের এই প্রধান কর্মকর্তারা বলেন, ‘আমরা এই নম্বর চালু করেছি। মিডিয়ার মাধ্যমে যতটুকু প্রচার হয়েছে, তার বাইরে আলাদাভাবে কিছু করা হয়নি। ব্যাপকভাবে প্রচার করতে পারলেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো। সেটা নিয়েও কাজ করবো।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন