চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে হাতে নেয়া প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার দুটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে ঢিমেতালে। নির্ধারিত মেয়াদে দুই প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় নতুন করে সময় বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে একটির ভৌত অবকাঠামোগত কাজ ৫২ শতাংশ ও অপরটির ৪০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। করোনাকালীন সংকট, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না পাওয়াসহ নানা কারণে এ দুটি প্রকল্পের কাজ প্রত্যাশিত গতিতে এগোচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ২০২২ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে। প্রকল্প দুটি সম্পন্ন হলে নগরীর দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে বলেও আশা করা হচ্ছে। তার আগ পর্যন্ত এ সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হচ্ছে না। তাই জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে নগরবাসীকে অপেক্ষা করতে হতে পারে আরও প্রায় দুই বছর।
এদিকে চলতি বছরও বর্ষা মৌসুম জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ সঙ্গী করে কাটাতে হয়েছে নগরবাসীকে। নগরীর বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর, জিইসি মোড়, চকবাজার, আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর, গোসাইলডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিতে কয়েক দফা হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি উঠেছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ চাক্তাই এলাকার ব্যবসায়ীদের জন্য বর্ষা মৌসুম এক অভিশাপের নাম। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, বাকলিয়া মৌসুমি আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা বর্ষায় জলাবদ্ধতার সঙ্গে যুদ্ধ করেই মৌসুম পার করেন। শুক্রবারও ভারি বৃষ্টিতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এদিন ১৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে পতেঙ্গার চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিস। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় অনেক স্থানে নালা-নর্দমার কাজ চলছে। নির্মাণ কাজের কারণে নালায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে বিভিন্ন স্থানে সড়কে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
তাছাড়া ৫ বছর পরপর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এলে মেয়র প্রার্থীদের নির্বাচনী ইশতেহারে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনকে প্রধান প্রতিশ্রুতি হিসেবে রাখা হয়। এ জলাবদ্ধতা ইস্যুকেই মেয়র পদে জয়-পরাজয়ের হাতিয়ার করেন তারা। প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমল থেকে সর্বশেষ মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন পর্যন্ত ২৭ বছর ধরে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি ইস্যু হিসেবে আছে। আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৭ বছর, তারপর বিএনপি থেকে নির্বাচিত এম মনজুর আলম ৫ বছর আবারও আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন। এ ২৭ বছরে চাক্তাই খাল খনন, তলা পাকাকরণ প্রকল্প থেকে শুরু করে জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত নানা প্রকল্পে কত শত শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু এর সুফল মেলেনি।
আ জ ম নাছিরের মেয়াদ শেষে আবারও ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ভোটের তারিখ ঘোষণা হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন আবারও জলাবদ্ধতা ইস্যুটিকে সামনে এনে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুত করেন। যদিও করোনার কারণে ওই নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনের নবনিযুক্ত প্রশাসক আওয়ামী লীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজনও এ জলাবদ্ধতা নিয়ে অনেকটা নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন। জলাবদ্ধতামুক্ত নগরীর স্বপ্ন দেখছেন তিনিও।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে চাক্তাই খাল খননসহ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ওইসব প্রকল্পের সুফল পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৭ সালে গ্রহণ করা হয় তিন বছর মেয়াদি একটি মেগা প্রকল্প। যার বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এটাই জলাবদ্ধতা নিরসনে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ওই বছরের জুলাইয়ে শুরু হয়ে প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ধীরগতির কারণে তা হয়নি। যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় সম্প্রতি প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। আর সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর।
প্রকল্পের অধীনে পাঁচটি খালে রেগুলেটর, খালের পাড়ে ১৭৬ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল, ৮৬ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ, ৪২টি সিল্ট ট্র্যাপ, দুটি পুকুর নির্মাণসহ নানা ধরনের কাজ রয়েছে। বর্তমানে এসব কাজ চলছে।
চউকের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এ প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোগত কাজ গত আগস্ট পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ।
প্রকল্প পরিচালক চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাঈনুদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন স্থানে রিটেইনিং ওয়াল ও রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। খালে চারটি রেগুলেটর নির্মাণের কাজও অনেক এগিয়েছে। রেগুলেটরের কাজ ৬০-৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। কাজের ধীরগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনার কারণে প্রায় ৬ মাস কাজ প্রত্যাশিত গতিতে করা যায়নি। এছাড়া প্রকল্পের অর্থ ছাড়ও চাহিদা অনুযায়ী হচ্ছে না। ২ হাজার কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণ বাদ দিলে ভৌত অবকাঠামোগত ব্যয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যা প্রায় ৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে আমরা ২ হাজার কোটি টাকা আশা করেছিলাম। সেখানে পেয়েছি ৮০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে চেয়েছিলাম দেড় হাজার কোটি টাকা। পাওয়া গেছে ৭০০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, করোনার কারণে পর্যাপ্ত ফান্ড পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। ফান্ড পেলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারব।
২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাকতাই খাল পর্যন্ত সড়ক ও বাঁধ নির্মাণের অপর একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চউক। এ প্রকল্পও চলছে ধীরগতিতে। ২০১৭ সালে শুরু প্রকল্পটির মেয়াদও চলতি বছরের জুনে শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পে খালে ১২টি রেগুলেটর ও ৯ দশমিক ৪০ মিটার সড়ক কাম বাঁধ নির্মাণের কথা রয়েছে। এ প্রকল্পের অর্ধেক কাজও এখন পর্যন্ত হয়নি।
প্রকল্প পরিচালক চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশ যুগান্তরকে বলেন, এ পর্যন্ত ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ১২টি রেগুলেটরের মধ্যে ৮টির কাজ শুরু হয়ে গেছে। বাকি চারটির কাজ পর্যায়ক্রমে ধরা হবে। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই রেগুলেটর নির্মাণ শেষ করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া সড়ক নির্মাণের কাজও চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এর মধ্যে আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এ পর্যন্ত ২৫ শতাংশ বরাদ্দ পাওয়া গেছে। রাজীব দাশ জানান, ২০২২ সালে কাজ শেষ হতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন