নোয়াখালীর নয় উপজেলায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও দস্যু বাহিনীর পাশাপাশি আরেক আতঙ্কের নাম ‘কিশোর গ্যাং’। এলাকায় এলাকায় খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ইভটিজিংসহ ভয়ংকর সব অপরাধ করছে উঠতি বয়সী তরুণ-যুবকদের এসব গ্যাং।
তাদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র, ছুরি, চাপাতি, ড্যাগার, রামদা, হকিস্টিকসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা এসব গ্যাং সদস্যদের কয়েকটি খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ততার কথা জানা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে রোষানলে পড়ে অসংখ্য মানুষ হামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন।
পৃথক ঘটনায় জেলার বিভিন্ন থানায় শতাধিক গ্যাং সদস্যের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। তবে কয়েকটি আলোচিত খুনের ঘটনা ছাড়া অন্যান্য অপরাধে তারা বেশিরভাগ সময়েই আইনের আওতায় আসেনি। নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ‘কিশোর গ্যাং’র এমন সন্ত্রাসী তৎপরতার চিত্র জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বিভিন্ন বয়সী ছেলেরা ‘কিশোর গ্যাং’ গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ‘কিশোর গ্যাং’ বলা হলেও এসব গ্রুপে কিশোর বয়স অতিক্রম করেছে এমন সদস্যও রয়েছে। এতে যেমন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী রয়েছে, তেমনি রয়েছে অছাত্ররাও।
বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর হয়ে কাজ করে কয়েকটি ‘কিশোর গ্যাং’র সদস্যরা। বয়সে ছোট হওয়ায় সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো অস্ত্র পরিবহনে অনেক সময়ে কিশোরদের ব্যবহার করে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে প্রাইমারি পড়ুয়া শিশুদেরও কিশোর গ্যাংয়ের হয়ে অস্ত্র ও মাদক পরিবহনে ব্যবহার করা হয়- এমন অভিযোগ রয়েছে।
যুগান্তরের হাতে আসা একটি ফুটেজে দেখা গেছে, সম্প্রতি বেগমগঞ্জ উপজেলায় একটি দোকানে হামলার সময় ছোট এক শিশুকে বড় এক রামদা নিয়ে কোপাতে দেখা যায়। দোকানের টিনে রামদাটি আটকে যাওয়ায় হাতলের সঙ্গে ঝুলে সেটি খুলতে দেখা যায় তাকে। এরা কিশোর গ্যাংয়ের ‘জুনিয়র সেটআপ’ হিসেবে কাজ করে।
জানতে চাইলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসী কাজ করে এমন কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। এসব ঘটনায় যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অপরাধী যে বয়সেরই হোক, সে অপরাধী। যে অপরাধ করবে তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে। অপরাধ করে কারও পার পাওয়ার সুযোগ নেই। এ সময় তিনি কিশোর অপরাধ দমনে সন্তানদের ওপর অভিভাবকদের তদারকি বাড়ানোর প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন।
১৬ অক্টোবর বেগমগঞ্জের মোজাহিদপুরে ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েল বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন স্থানীয় মুসল্লিরা। বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, সাধারণ মানুষকে হয়রানিসহ নানা অপরাধে এ বাহিনীর বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে সেই বিক্ষোভ থেকে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
এরপর এ এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনীর খোঁজে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখে যুগান্তর। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে ভয়ংকর রয়েল বাহিনীর বেশ কিছু সশস্ত্র ছবি আসে যুগান্তরের হাতে।
একটি ছবিতে দেখা যায়, রয়েল বাহিনীর সদস্যরা একটি অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছে। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, অস্ত্র তাক করে, একজনের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে তারা পোজ দিচ্ছে। এসব ছবিতে থাকা অন্তত চারজনের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ফেস্টুন ও পোস্টার দেখা গেছে।
পরে এসব ছবি নিয়ে এলাকার অন্তত ১৬ জনের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। তারা এসব ছবিতে থাকা গ্যাং সদস্যদের চিহ্নিত করেন। সেখানে রয়েছে রয়েল গ্রুপের সদস্য এমাম, ঈমন, বিপ্লব, অন্তর, শামিম, হৃদয়, কুমার নামের সাত কিশোর।
এ গ্রুপের ১৪ জন ‘কোর মেম্বার’ রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। এর মধ্যে রয়েছে- সাহাব, রানা, রোমন, শাকিল, নোমান, জাবেদ ও সামছু। স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্য মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা অপকর্ম করে থাকে।
তবে বেশ কয়েকজন অভিযুক্তের স্বজনদের কাছে গেলে তারা এ ছবি বানানো বলে দাবি করেন। অনেকে আবার নামের কথা জিজ্ঞেস করলে এ নামের অন্য কেউ গ্রুপের সদস্য বলে দাবি করেন।
নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা এসব গ্যাংয়ের সদস্যদের কয়েকটি খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ততার কথা জানা গেছে।
৮ মে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ‘কিশোর গ্যাং’য়ের হামলায় হাফেজ ছাত্রলীগ কর্মী শেখ জাহেদ (১৮) খুন হন। রামপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে গ্যাং সদস্যদের এ হামলায় আহত হন আরও দু’জন।
নিহতের মামা রেজাউল হক সোহাগ জানান, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওয়ার্ডের কিশোর গ্যাং হৃদয় গ্রুপের সদস্য আমির হোসেন, নূর হোসেন, রাশেদ, হৃদয়, অপুসহ ১৫ থেকে ২০ জন প্রকাশ্যে পিটিয়ে জাহেদকে হত্যা করে। এ ঘটনায় করা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে।
৭ আগস্ট বেগমগঞ্জে পুকুরে গোসল করার দ্বন্দ্বের জেরে কিশোর গ্যাং সদস্যরা মো. হৃদয় (২৩) নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে খুন করে। নিহতের চাচা মাসুদ জানান, পুকুরে গোসল নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে কিশোর গ্যাং সোহাগসহ ৭-৮ জন হৃদয়ের পেটে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে খুন করে। পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় বেগমগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত হত্যা মামলায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৫ জনকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
৩০ সেপ্টেম্বর মামলায় সাক্ষী দিতে রাজি না হওয়ায় বেগমগঞ্জে এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে খুন করে কিশোর গ্যাং। নিহত রাশেদ আহমেদের (৪৮) বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার চন্দ্রগঞ্জ থানার পূর্ব সৈয়দপুর গ্রামে।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, রাশেদ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এলাকার রিয়াজ নামে এক সন্ত্রাসীর করা মামলার সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু তিনি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে রাজি না হওয়ায় বাদী কিশোর গ্যাং লিডার রিয়াজ তাকে দেখে নেবে বলে হুমকি দেয়।
এরপর গ্যাংয়ের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড শান্তসহ কয়েকজন অস্ত্রের মুখে চন্দ্রগঞ্জ থানার কালারপুল এলাকা থেকে টেনেহিঁচড়ে রাশেদ আহমেদকে মারতে মারতে নোয়াখালীর সীমান্তবর্তী বেগমগঞ্জের ছয়ানীর আমিরপুর নিয়ে হত্যা করে। এরপর মরদেহ ধানক্ষেতের পানিতে ফেলে চলে যায়।
জানা যায়- নোয়াখালীতে ছিনতাই, ধর্ষণ, লুটপাট, জমি দখল ও মাদক ব্যবসাসহ সবই করছে এ ‘কিশোর গ্যাং’। এরা বেশিরভাগ সময় মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে অপারেশনে যায়।
ছোট গ্রুপগুলোর কাছে ৫-৭টা মোটরসাইকেল রয়েছে। আবার বড় গ্রুপের কাছে ১০-২০টা মোটরসাইকেল রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই আবার ‘চোরাই’ বা ‘টানা’। ট্রাফিক পুলিশ, থানা ও হাইওয়ে পুলিশের সামনে দিয়েই তাদের চলাচল। কখনও কখনও প্রয়োজনে তারা অন্য গ্রুপের থেকে মোটরসাইকেল ধার নেয় বলেও জানা গেছে।
সরেজমিন স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বেগমগঞ্জ উপজেলা সদরে কয়েকটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এদের সদস্য সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। চৌমুহনী বাজার, একলাশপুর, চৌরাস্তা, রমজান বিবি, মেডিকেল কলেজ এলাকা, হাজীপুর ও জমিদারহাটে এদের রাজত্ব রয়েছে। এছাড়া সন্ত্রাসী গ্রুপ- সম্রাট বাহিনী, সুমন বাহিনী, নিজাম বাহিনী, কাতা রাসেল বাহিনীর হয়েও কাজ করে কয়েকটি কিশোর গ্যাং।
এর মধ্যে কাতা রাসেলের কিশোর গ্যাং গ্রুপে রয়েছে হৃদয় বাহিনী। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠেছে আরও কয়েকটি গ্যাং। সেনবাগে রয়েছে জয় নামের একজনের একটি গ্রুপ।
এখানে আরও এমন চারটি কিশোর গ্যাংয়ের কথা জানা গেছে। নোয়াখালী সদরে ১৩টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ১১টি কিশোর গ্যাং রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। যেসব এলাকায় এদের প্রভাবের কথা বিশেষভাবে জানা গেছে সেগুলো হল- লক্ষ্মীনারায়ণপুরের কাশেম উকিল বিল্ডিং সংলগ্ন এলাকা, ১১নং নেয়াজপুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রাম, দানামিয়া বাজার, কাশেম বাজার ও জাহানাবাদ গ্রাম। আরও জানা গেছে, চাটখিলে ৩টি, সুবর্ণচরের ৫টি, সোনাইমুড়ীতে ৪টি, হাতিয়ায় ৭টি, কবিরহাটে ২টি ও কোম্পানিগঞ্জে ৪টি বড় কিশোর গ্যাং রয়েছে।
টর্চার সেল : বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের ‘টর্চার সেল’ গড়ে তোলার খবর পাওয়া গেছে। কখনও অর্থ আদায়ে, কখনও প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে, আবার কখনও মাদকের আসর বসাতে এসব টর্চার সেল ব্যবহার হয়। বিভিন্ন ‘বিচার’ করারও দায়িত্ব নেয় এসব গ্যাং। টর্চার সেলের জন্য স্থায়ীভাবে বাসা বা ভবন না থাকলেও গ্যাং সদস্যরা টার্গেটকৃত বিভিন্ন স্থানকে প্রয়োজন অনুযায়ী নির্যাতন উপযোগী করে নেয়।
স্থানীয়রা জানান, ২৬ আগস্ট নোয়াখালী শহরের মাইজদি বাজার এলাকার চন্দ্রপুর আহমদ মঞ্জিলের নিচতলা থেকে জনৈক আবদুল কাইয়ুমের একটি মোটরসাইকেল চুরি হয়। কাইয়ুম পার্শ্ববর্তী টিভি সেন্টার এলাকার আতাউর রহমানকে মোটরসাইকেল চুরির সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করে। ওই দিন রাত ৯টায় এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য- রাজু, বাবু, বাবুল, শাকিলসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৭-৮ জন আতাউর রহমানের বাসায় যায়।
এরপর তারা আতাউর রহমানের হাত-পা ও মুখ বেঁধে তাকে অপহরণ করে মাইজদী আহম্মদ মঞ্জিলের ৪ তলায় এনে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করে। দেয়া হয় ইলেকট্রিক শকও।
একপর্যায়ে তার কাছ থেকে ৩০০ টাকার সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এ ফাঁকে কিছু সন্ত্রাসী আতাউর রহমানের বাসায় গিয়ে তার বাসার ফ্রিজ, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ অন্যান্য মালামাল লুট করে নিয়ে আসে। এ ঘটনায় দায়েরকৃত একটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন