দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহালমের বিরুদ্ধে দুদকের মামলায় নবীন ও অনভিজ্ঞ কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নিয়ে হাইকোর্ট যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সেটি দুদকের জন্য একটি সতর্কবার্তা বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
তিনি বলেন, ‘জাহালমকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রশ্নে জারি করা রুল কিছু পর্যবেক্ষণ সহকারে নিষ্পত্তি করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে ব্র্যাক ব্যাংককে এ ঘটনার জন্য দায়ী করে ৩০ দিনের মধ্যে জাহালমকে ১৫ লাখ টাকা দিতে বলেছেন। এছাড়া দুদককে ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুলভ্রান্তি যাতে না হয় সে জন্য সতর্ক থাকতে বলেছেন।
রায় ঘোষণার পর সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে উপস্থিত সাংবাদিকদের দুদকের এই আইনজীবী বলেন, আমি মনে করি দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা। কারণ আদালতও বলেছেন, এই প্রতিষ্ঠানের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক।
খুরশীদ আলম খান আদালতের রায়ের বিষয়ে আরও বলেন, আমরা আইনের আলোকে বিবেচনায় নিচ্ছি যে দুদক কাজটি করেছে সরল বিশ্বাসে। এখানে দুদকের অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না।
এর আগে বুধবার বিকেলে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের মামলায় জাহালমের তিন বছর জেলখাটার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাকে ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১৫ লাখ টাকা দেবে বলে নির্দেশনা দিয়ে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন।
এই টাকা পরিশোধের পর এক সপ্তাহের মধ্যে তা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংকঋণ সংক্রান্ত ৩৩ মামলায় পুনরায় শুরু হওয়া তদন্ত কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করে তা নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন।
এছাড়া এ ঘটনায় দুদকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে করা বিভাগীয় মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালত বলেছেন, এক্ষেত্রে আমরা একটা স্বচ্ছ চিত্র দেখতে চাই।
রায় ঘোষণার সময় জাহালম সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন। আদালতে জাহালমের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র দাস, দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান, ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আমিনুল হাসান, সিটি ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন সামির সাত্তার, সোনালী ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার শেখ জাকির হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এম সাইফুল আলম।
রায়ের পর জাহালম সাংবাদিকদের বলেন, আদালত ১৫ লাখ টাকা দিতে রায় দিয়েছেন। তাতে আমি সন্তুষ্ট, আদালতের রায়ে আমি খুশি। এই টাকা তাড়াতাড়ি চাই। দ্রুত টাকা পেলে দায়দেনা পরিশোধ করব।
আদালতের বরাত দিয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার গণমাধ্যমে রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, দুদক দেশের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতি রোধ করাই যাদের প্রধান কাজ। তারা স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ করবে। জনগণের প্রত্যাশা, সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে স্বচ্ছভাবে দায়িত্ব পালন করবে।
আদালত বলেন, আমরা আশা করি, দুদক ভবিষ্যতে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকবে। দুদকের করা মামলায় যেন নিরাপরাধ আর কাউকে জেল খাটতে না হয়। জাহালমের মতো ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না হয়।
গত বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর রায়ের জন্য দিন ঠিক করেন। এর আগে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি জাহালমের ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে রুলের শুনানি শেষে যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করবেন বলে অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন আদালত।
২০১৯ সালের জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না...’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত।
এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা, মামলার বাদীসহ চারজনকে তলব করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ। এছাড়া রুলও জারি করেন।
একই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্টরা হাজিরের পর হাইকোর্ট জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেন এবং দুদকের কাছে ঘটনার বিষয়ে হলফনামা আকারে জানতে চান। সে আদেশ অনুসারে দুদক হলফনামা আকারে তা উপস্থাপন করেন।
পরে জাহালম প্রশ্নে ব্যাংকঋণ জালিয়াতির ৩৩ মামলার এফআইআর, চার্জশিট, সম্পূরক চার্জশিট ও সব ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত নথিপত্র দাখিল করতে দুদককে নির্দেশ দেন।
এরই ধারাবাহিকতায় হাইকোর্ট গত ১৭ এপ্রিল জাহালমকাণ্ডে কে বা কারা দায়ী তা দেখার জন্য এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদন চেয়েছিলেন। পরে এসব মামলায় দুদক, ব্র্যাক ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবু সালেকের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটেন, আদালতে অনবরত হাজিরা দিয়ে যান এই জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন