ইসলামের প্রথম কিবলা আল-আকসাকে (আল-আকসা মসজিদ) মুক্ত করতে জীবনের ৩৬টি মূল্যবান বছর পার করেছেন চাঁদপুরের সৈয়দ আহম্মদ। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাওয়া এই বাংলাদেশির নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ফিলিস্তিনিও’। ইয়াসির আরাফাতের খুব কাছের নিরাপত্তাদলের সদস্য ২০১৪ সালে অবসর নিয়েছেন ‘ক্যাপ্টেন’ থাকা অবস্থায়। ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি, এক এক করে আরবদেশগুলোর স্বীকৃতি নিয়ে ভাবেন সৈয়দ আহম্মদ। গতকাল শুক্রবার বিকেলে তিনি টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, এখনো তিনি বিশ্বাস করেন, ফিলিস্তিন পুরোপুরি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। আল-আকসা মসজিদ মুক্ত হবে। সংকট যত বাড়বে সমাধানের সুযোগও সৃষ্টি হবে।
এই সৈয়দ আহম্মদ সত্তরের দশকে ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করতে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া একমাত্র ব্যক্তি নন। ফিলিস্তিনের সংগ্রামের সঙ্গে বাংলাদেশিদের সমর্থন, সম্পৃক্ততা, অংশগ্রহণের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়ও এ দেশ থেকে অনেকে গিয়ে সেই যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে বার্তা পাঠালেও বাংলাদেশ তা গ্রহণ করেনি, প্রাপ্তি স্বীকারও করেনি। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যখন বেশির ভাগ আরবদেশই দ্বিধাগ্রস্ত ছিল তখনো ফিলিস্তিন ও এর জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল উষ্ণ। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণসামগ্রী ও চিকিৎসকদল পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিন ইস্যুতে বৈশ্বিক ফোরামে অন্য অনেক আরবদেশের চেয়েও সোচ্চার বাংলাদেশ। ফিলিস্তিনের পক্ষে বাংলাদেশে যখন ব্যাপক জনমত তখন আরবদেশগুলো এক এক করে ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও বাহরাইনের পর মধ্যপ্রাচ্যের আরো সাত থেকে ৯টি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করতে যাচ্ছে বলে বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত বুধবার তিনি হোয়াইট হাউসে এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, সৌদি বাদশাহ সালমানের সঙ্গে কথা বলার পর তাঁর মনে হয়েছে যে সৌদি আরবও যথাসময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়তে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে আরবদেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগকে ভোট টানার কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। ট্রাম্পের উদ্যোগে ইসরায়েল-বাহরাইন ও ইউএই শান্তিচুক্তির প্রভাব প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্ক সিটির এশিভা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইহুদি ইতিহাসবিষয়ক স্কলার মাইকেল উইনার এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আমি বাইডেনকে (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন) ভোট দেওয়ার জন্য মনস্থির করেছিলাম। কিন্তু এখন ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিচুক্তি করে ফেলেছেন!’ তিনি আরো লিখেছেন, জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা যখন বাড়ছে তখন ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ওই চাল দিলেন।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে তার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আবারও জয়ী করতে ‘শেতাঙ্গ’ ভোট টানার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাচও গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সেই পুরনো সময়ের মতো ঠিক সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় চাপ দিয়ে তার স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তিনি ‘সাইকোপ্যাথ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ড. ইমতিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, একজন আমেরিকান যখন তাঁর দেশের প্রেসিডেন্টকে ‘সাইকোপ্যাথ’ বলে অভিহিত করছেন তখন তো না বোঝার কোনো কারণ নেই যে এখানে ফিলিস্তিনিদের মুক্তির কোনো প্রশ্ন নেই। বরং এটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী কৌশল।
ঢাকায় ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ রামাদান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও বাহরাইনের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সম্ভবত দুটি কারণ থাকতে পারে। একটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আবারও জয়ী হতে সাহায্য করা। অন্যটি দুর্নীতির অভিযোগে বেশ চাপে থাকা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পক্ষে সমর্থন দেওয়া।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আগামী নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের আবারও বিজয়ী হওয়ার জন্য ইহুদি ভোটারদের ভোটও প্রয়োজন। ওয়াশিংটন ডিসির আরব সেন্টারের ফেলো জো ম্যাকরনের মতে, উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিতে আরব-ইসরায়েল সংঘাত মিটবে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আসন্ন নির্বাচনে ওবামার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী জো বাইডেনকে পরাজিত করতে চান। একই সঙ্গে তিনি ২০০৯ সালে ওবামার মতো নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে চান।
জো ম্যাকরনের যুক্তি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ট্রাম্প যে সমস্যায় আছেন তা দূর করতে তাঁর পররাষ্ট্রনীতির ‘সাফল্য’ প্রয়োজন। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সারা বিশ্বে চুক্তি করতে ট্রাম্প তাঁর উপদেষ্টাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
তবে ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও তাদের মধ্যে সম্পর্ক ‘ওপেন সিক্রেট’ বলেই মনে করেন কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আরো বলেন, “যেসব দেশ স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং এমনকি সৌদি আরবও যদি দেয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ তারা বহু বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে ভালো ধরনের সম্পর্ক রেখেছিল। এটাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ওপেন সিক্রেট’। সবাই জানত সৌদি আরব থেকে শুরু করে আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ আজকের মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের ইসরায়েলের সঙ্গে এত বড় সম্পর্ক ছিল বলেই ফিলিস্তিনিদের কিছু হয়নি এবং ইসরায়েল যা কিছু করার করতে পেরেছে। এটা সবাই জানত।”
ড. ইমতিয়াজ বলেন, ‘সৌদি রাষ্ট্রদূত, সৌদি বাদশাহ, ইসরায়েলের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, কোথায় টাকা রাখে—এগুলো নিয়ে অনেক লেখালেখি আছে। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো তারা সবাই আমেরিকাপন্থী। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা আরব দেশগুলোতে আছে বলেই ওই বাদশাহরা আছেন। রাজতন্ত্র টিকে আছে, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র টিকিয়ে রেখেছে। এটা তো অস্বীকার করা চলবে না। ওরা ইসলামের নাম ভেঙে খাচ্ছে।’
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেনও বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের ব্যাপক সম্পর্ক। কিন্তু তারা কখনো এ বিষয়টি সামনে আনে না বা প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। আরব অনেক দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে বাংলাদেশের যে অবস্থান তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আগামীতে সৌদি আরবও যদি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তবে তিনি অবাক হবেন না। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গড়ার কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের অবস্থান ফিলিস্তিনের পক্ষে। ফিলিস্তিন যদি ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তবেই বাংলাদেশের সম্পর্ক গড়ার প্রশ্ন আসতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক পররাষ্ট্রনীতিতেও ‘সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা বা জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সারা বিশ্বের সকল নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর’ কথা বলা হয়েছে।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে লাভবান হবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন