বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার নামে রোগীদের নানাভাবে জিম্মি করার ঘটনা নতুন কিছু নয়। যখনই কোনো অভিযোগের মুখে কোনো হাসপাতালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালায় তখনই ধরা পড়ে নানা অনিয়ম ও অপকর্ম। এবার করোনাভাইরাসের মহামারিকে পুঁজি করে বহুল আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতাল, জেকেজি হেলথকেয়ারের পর শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ আরো কয়েকটি হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এমন অবস্থায় আবারও এক শ্রেণির বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবসায়ী সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে। চাপের কাছে নতি স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর আগে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এবার একইভাবে নতি স্বীকার করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে মন্ত্রণালয়।
গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে হাসপাতালে অভিযান নিয়ে অসন্তোষ ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, যদি জরুরি কোনো কারণে অভিযান পরিচালনা করতেই হয় তাহলে আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। সেই সঙ্গে অভিযানের বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
কলাম লেখক ও স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন বিষয়ের পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করা সৈয়দ আবুল মকসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজেরা যদি সঠিক নিয়মনীতির মধ্যে হাসপাতালগুলোকে রাখতে পারত তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিযানে যেতে হতো না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ই বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে।’
চিঠির বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ওই চিঠিতে অভিযান চালাতে না করিনি। আমরা বলেছি, অভিযান করতে হলে আমাদের অবহিত করে নিতে। তা না হলে যদি হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া বা কোনো বিশৃঙ্খল অবস্থার তৈরি হয় সেটা মানুষের চিকিৎসার জন্য ভালো হবে না।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতির মধ্যে সাধারণ রোগী বা সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষার বদলে স্বাস্থ্যসেবার নামে যারা ব্যবসা করছে তাদেরই সুরক্ষা দেওয়ার কৌশল বেছে নেওয়া হয়েছে। অপকর্ম যারা করছে তারা এই সুযোগ নিয়ে পার পেয়ে যাবে।’
সরকারের অবস্থানকে অনেকটা সমর্থন করে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবার বিষয়গুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই সমাধান করতে হবে। তাদের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে অন্য কোনো সংস্থা তৎপরতা চালালে পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। সেটা এড়াতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন যে উদ্যোগ নিচ্ছে সেগুলো কার্যকর করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র থেকে জানা যায়, দেশে মোট ১৭ হাজার ২৪৪টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন সময়ে নিবন্ধন নিয়েছে। এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অর্ধেকের বেশির নিবন্ধন নবায়ন করা নেই।
অভিযোগ রয়েছে, অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা নিবন্ধন নবায়ন না করা শত শত হাসপাতাল-ক্লিনিকের সঙ্গে বিশেষ সমঝোতা করে বছরের বছর তাদের বাণিজ্য চালিয়ে যেতে সহায়তা করছে। যখন কোনো বড় ঘটনা ঘটে তখন নিজেদের দায় এড়ানোর সুযোগ নিতে নবায়ন না থাকার কথা প্রকাশ করে বা হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ দেয়। এর আগে কয়েকটি হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু, ভুয়া চিকিৎসক দিয়ে রোগীর অস্ত্রোপচারের মতো ঘটনা র্যাবের অভিযানে ধরা পরার পর নিবন্ধন না থাকার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূইয়া বলেন, ‘সরকারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করিনি, বরং সরকারকে সহায়তা করতে চাই। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় প্রাইভেট সেক্টর যে ৬০ শতাংশ অবদান রাখছে, সেটা কিন্তু সবাইকে মাথায় রাখতে হবে।’ তাঁর দাবি, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল হয়ে আছে অনেক সূচকে।
ডা. মনিরুজ্জামান বলেছেন, অনেক হাসপাতালই আছে, তারা সব খরচ চালিয়ে আয় করতে পারে না। নিবন্ধন নবায়ন ফি পাঁচ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করায় উপজেলা বা জেলা, এমনকি ঢাকার অনেক ছোট হাসপাতাল বা ক্লিনিকের পক্ষেও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নিবন্ধন ও নবায়নের ক্ষেত্রে আরো জটিলতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলোর সংস্কার করা প্রয়োজন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন