বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হচ্ছে এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রতিদিন যেভাবে শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে, যেভাবে মৃত্যু স্থিতিশীল আছে, তাতে সামনের দিনগুলো ভয়ঙ্কর। কিন্তু গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সম্পর্কিত যে তথ্যগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশ করেছে, সেই তথ্যগুলো বলছে যে আমরা যা অনুমান করছি তাঁর থেকেও ভয়ঙ্কর পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিছু কিছু তথ্য আমাদের গা শিউরে ওঠার মতো এবং এই তথ্যগুলোই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সামনে আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে। যে পরিণতির জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত নই। আমরা যদি তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যাবে যে, কি ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে আমরা দ্রুত ধাবিত হচ্ছি।
১. আক্রান্তের হার
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণের যে হিসেব স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিয়েছে তাতে দেখা গেছে যে, ৯ হাজার ৪৫১ জনের পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৯৭৫ জন। এই শনাক্তের হার ২০ শতাংশের একটু বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতি ৫ জন মানুষের মধ্যে একজন করোনা সংক্রমিত। এই যদি উপাত্ত হয়, যা দুই লাখ ৫৩ হাজার ৩৪ জনের মধ্যে পরিচালিত, তাহলে বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যায় অধ্যুষিত এই জনপদের পরিস্থিতি কি তা অনুমানের জন্য কোন বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। সবথেকে বড় কথা হচ্ছে যে, এখন এই বিপুল জনসংখ্যাকে কি পরীক্ষার আওতায় আনা সম্ভব? অসম্ভব ব্যাপার। তাই যদি হয় তাহলে বাংলাদেশের সামনে কি পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এখন সব মানুষকে যদি পরীক্ষার আওতায় আনা না যায় তাহলে পরীক্ষাহীন মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়বে এবং এর পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর।
২. সুস্থ হওয়ার থেকে আক্রান্ত বাড়ছে
বাংলাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় যে সুস্থতার হিসেব, তাঁর সঙ্গে আক্রান্তের যে পার্থক্য তা ক্রমশ বাড়ছে। আমরা যদি দেখি যে, গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছে ৪৩৩ জন এবং আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৯৭৫ জন। অর্থাৎ ১৫৪২ জন নতুন রোগী সংযুক্ত হয়েছে এবং সার্বিকভাবে দেখলে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজার ৫৮৫ জন করোনা রোগী রয়েছে। এর বিপরীতে সুস্থ হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৩৩৪ জন। এই ব্যবধান প্রতিদিন বাড়ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন নতুন করে যদি দেড় হাজার রোগী সংযুক্ত হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে কি পরিস্থিতি হবে তা বলাই বাহুল্য।
৩. বেসরকারি হাসপাতালগুলো হবে করোনার হটস্পট
বাংলাদেশে এভাবে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়লে বিশেষায়িত হাসপাতাল বা সরকারি হাসপাতাল এককভাবে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে পারবে না। এর ফলে অনিবার্যভাবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে যুক্ত করতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো ইতিমধ্যে যুক্ত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত নামীদামী বেসরকারি হাসপাতাল, যেমন ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল করোনা চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছে এবং সর্বশেষ আজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিংয়ে ল্যাব এইড-ও করোনা পরীক্ষায় হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। আমরা জানি যে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন যারা চিকিৎসা নিতে যান তাঁরা সবাই প্রায় মুমুর্ষু রোগী। কারণ সাধারণ অসুখবিসুখে এখন কেউ হাসপাতালমূখী হননা। মুমূর্ষু রোগীদের মধ্যে রয়েছে ক্যান্সারের রোগী, হৃদরোগী এবং কিডনী রোগী। এই সব লোকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম। ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যখন করোনা চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, তখন এই হাসপাতালগুলো হবে করোনার হটস্পট এবং তখনই হঠাত করে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে।
৪. বেড়েই চলেছে মৃত্যু
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণে যে আশার বাণীটি এখন পর্যন্ত রয়েছে তা হলো মৃত্যুর সংখ্যা কম। গত ২৪ ঘণ্টায় ২১ জন মারা গেছে। অন্যান্য দেশগুলোতে সমপরিমাণ আক্রান্তের হারে এই মৃত্যুহার অত্যন্ত আশা জাগানিয়া। কিন্তু যদি এভাবে সংক্রমণের হার বাড়তেই থাকে এবং যদি আমরা কোন পিক নির্ধারণ না করতে পারি তাহলে প্রতিদিন এভাবে নতুন আক্রান্তের সঙ্গে মৃত্যু সংখ্যা বাড়বে এবং মৃত্যু মিছিল দীর্ঘ হবে। সেটা রেকটি ভয়াবহ পরিণতির দিকে আমাদের নিয়ে যাবে।
৫. উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু কে গুনবে?
একদিকে দেখা যাচ্ছে যে বহু মানুষ পরীক্ষার আওতার বাইরে থাকছে, বহু মানুষ লোকলজ্জার ভয়ে উপসর্গ গোপন করছে এবং বহু মানুষ উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছে। এই উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুগুলোকে করোনায় মৃত্যু বলে হিসেবে আনা হচ্ছেনা। ফলে একটি পর্যায়ে যদি এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, হাসপাতালগুলো করোনা রোগীর ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়বে, নতুন রোগী নেয়ার মতো পরিস্থিতি থাকবে না, আমাদের পরীক্ষা করার ক্ষমতা হ্রাস পাবে, উপসর্গহীন বহু মানুষ অসুস্থ থেকে চিকিৎসার বাইরে থাকবে এবং উপসর্গ নিয়ে তাঁরা মৃত্যুবরণ করবে। এরকম পরিস্থিতি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই শুধু ভেঙে পড়বে না, সামগ্রিক আর্থসামাজিক অবস্থাকেও একটি ভয়ঙ্কর ঝাঁকুনি দিবে।
একারণেই এই তথ্যগুলো এটাই জানান দিচ্ছে যে, সামনে আমাদের জন্য কোন সুখবর নেই, সামনে কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে, সামনে আমাদের শুধুই অন্ধকার সময়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন