বৈশ্বিক সমস্যা করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) ও সুপার সাইক্লোন আম্ফানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মুখে ঈদের আনন্দের হাসি নেই। ঈদের আনন্দ তাদের কাছে বিষাদ মনে হচ্ছে। ধান, আম, মাছ, লিচু, তরিতরকারি, ভুট্টা, হাঁস, মুরগি, গরু ও ছাগল হারিয়ে তারা এখন দিশেহারা। শুধু উপকূলের জেলাগুলোই নয়; রাজশাহী, রংপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ সারাদেশেই কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
করোনার ক্ষতি পুষিয়ে না উঠতেই সুপার সাইকোন আম্ফানের তাণ্ডব লীলা অনেক কৃষককে নিঃস্ব করে দিয়েছে। বিশেষ করে উপকূলে যারা এ ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তাদের কাছে এবারের ঈদ মোটেই আনন্দের নয়।
এর আগে করোনার কারণে ৫০ টাকা লিটারের দুধ ১০ টাকা, ৩৫ টাকার মুরগির বাচ্চার দাম ১ টাকা, ১৪০ টাকা কেজির ব্রয়লার মুরগি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, বেগুনের কেজি ২ টাকা কেজি বিক্রি করতে হয়েছে কৃষকদের। আর তরিতরকারি তো জমিতে পচেছে। এছাড়া বাঙ্গি জমিতে ফেটেছে, তরমুজ গড়াগড়ি খেয়েছে খেতে। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই সুপার সাইক্লোন আম্ফানের হানা। বিশেষ করে উপকূলের অনেক কৃষক নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এ কারণে ঈদ তাদের কাছে আনন্দের বা খুশির মনে হচ্ছে না।
এমনিতেই করোনার কারণে এবার সারাদেশের কৃষক তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম পাননি। এর ওপর আম্ফান ঘূর্ণিঝড় কৃষকের জন্য ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো অবস্থা হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ঝড়ের পরের দিন বলেছেন, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের ৪৬টি জেলার প্রায় এক লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ২০ ধরনের ফসল নানা মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ঝড়ে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে মৌসুমি ফল, সয়াবিন, বোরো ধান, মুগ ডাল ও গ্রীষ্মকালীন সবজি।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ৪৭ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান, ৩ হাজার ২৮৪ হেক্টর ভুট্টা, ৩৪ হাজার ১৩৯ হেক্টর পাট, ২ হাজার ৩৩৩ হেক্টর পান, ৪১ হাজার ৯৬৭ হেক্টর সবজি, ১ হাজার ৫৭৫ হেক্টর চীনাবাদাম, ১১ হাজার ৫০২ হেক্টর তিল, ৭ হাজার ৩৮৪ হেক্টর আম, ৪৭৩ হেক্টর লিচু, ৬ হাজার ৬০৪ হেক্টর কলা, ১ হাজার ২৯৭ হেক্টর পেঁপে, ৩ হাজার ৩০৬ হেক্টর মরিচ, ৬৪০ হেক্টর সয়াবিন, ৭ হাজার ৯৭৩ হেক্টর মুগ ডাল এবং ৬ হাজার ৫২৮ হেক্টর জমির আউশ ধানের চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মাগুরা সদর উপজেলার হাজরাপুর কৃষক উন্নয়ন সমিতির সদস্য কাজী সাইফুল ইসলাম বলেন, উপজেলার হাজীপুর, হাজরাপুর, রাঘবদাইড় ইউনিয়ন, আঠারখাদা, মঘি ও পৌরসভার কিছু এলাকায় ছোটবড় সবমিলিয়ে ২০ হাজারের ওপরে লিচু, আম, কাঁঠাল, কলা ও পেঁপে বাগান রয়েছে। যার মধ্যে জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল লিচুর বাগান রয়েছে প্রায় সাত হাজার। কিন্তু বুধবার (২০ মে) সারা রাতের ঝড়ের তাণ্ডবে গোটা এলাকার সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, প্রতিবছর এ এলাকা থেকে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার আম ও লিচু বিক্রি হয়ে থাকে। তবে এবার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা তাদের ফসলহানিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কারণ, এসব ফসল বিক্রির টাকায় সারাবছর পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার চরপাড়া গ্রামের কৃষক আকিমুদ্দিন শেখকে টেলিফোনে জানতে চাওয়া হয় কেমন আছেন। উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষক মানুষ কেমন থাকব! দুর্যোগ আমাদের পিছু ছাড়ছে না। এবারের ঝড়ে ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে আমরা আর উঠে দাঁড়াতে পারব না।’ ঈদ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘করোনা, আম্ফান ঝড় এত কিছু মাথার ওপর দিয়ে যাওয়ার পর আর ঈদ থাকে?’
বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের হাজারবিঘা গ্রামের বাসিন্দা আবদুস সালাম বলেন, এ বছর ১০ শতাংশ জমিতে মরিচ চাষ করেছিলাম কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পানি ঢুকে খেতের মরিচ ও গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, প্রতিবছর চার থেকে পাঁচ মণ মরিচ ঘরে তুলি আমি। কিন্তু এ বছর আমাদেরই মরিচ কিনে খেতে হবে।
কুমড়াখালি এলাকার সবজি চাষি কালাম বলেন, ৪০ শতাংশ জমিতে এ বছর করলা চাষ করেছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে করলা খেত নষ্ট হয়ে গেছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।
২০ শতাংশ জমিতে চিনাবাদাম আবাদ করেছিলেন খেজুরতলা গ্রামের কৃষক নাসিরুদ্দীন। ফলনও ভালো হয়েছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ে পানি ঢুকে সব নষ্ট হয়ে গেছে তার। সোনারবাংলা গ্রামের কৃষক ইউনুস জোমাদ্দার বলেন, ৪০ শতাংশ জমিতে তিল চাষ করেছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে খেতে পানি ঢুকেছিল। কিন্তু পরে পানি নেমে গেলেও খেতের গাছ শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন