২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯; সেদিনও পূর্ব আকাশে উকি দিয়ে সূর্য উঠেছিল, মাথার ওপরে ছিল সূর্যের সোনালি হাসি। সূর্যের স্বর্ণালী রৌদ্র সেদিন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মাত্র দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই দেশপ্রেমিক সেনাদের তাজা রক্তের রংয়ে লাল হয় সেই হাসি।
সেদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) বার্ষিক দরবারের দিন। একদিন আগেই পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরে তিনদিনব্যাপী রাইফেলস সপ্তাহের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বর্ণাঢ্য ওই আয়োজনের দ্বিতীয় দিন। সেদিন পিলখানার ভেতরে ছিল উৎসবের আমেজ। এর আড়ালেই ঘাতকরা ষড়যন্ত্রের ছক আঁকে। শুরু করে ভয়ঙ্কর নৃশংসতা।
অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ৯টায় সদর দফতরের দরবার হলে। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপ-মহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানা পদের সদস্যরা। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন দুই হাজার ৫৬০ জন।
দরবার শুরুর পর ডিজির বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ। দরবার হলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানেরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন। ডিজি নিজে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানসহ অন্যদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে দ্রুত সেনা হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে।
এরপর পিলখানার ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন বিদ্রোহীরা। এ সময় প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বিদ্রোহীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। তারা মাইকে জানায়, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে।
আলোচনার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বেলা দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদা পতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নানক সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানেরা। তারা আগের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেন।
কিন্তু আত্মসমর্পণের আগেই ঘটে গেছে দেশের ইতিহাসের কলঙ্কময় ও লজ্জাকর এক অধ্যায়। যেসব লজ্জাকর ও অগৌরবের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে, পিলখানা ট্র্যাজেডি তার একটি। রূঢ় ভাষায় বললে এটি আমাদের ইতিহাসে এক দগদগে ঘা।
অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে পিলখানায় নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে মহাপরিচালকসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহত হয় নারী ও শিশুসহ আরও ১৭ জন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রী, বাসার কাজের মেয়ে ও বেড়াতে আসা আত্মীয়রাও।
নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, অমানবিকতার যত হীনদৃষ্টান্ত বিশ্বে স্থাপিত হয়েছে, সেগুলোর কাতারে ফেলা যায় এ ঘটনাকে। এর ফলে সেনাবাহিনী যেমন প্রতিভাবান, সুদক্ষ, চৌকস সেনা অফিসারদের হারায় তেমনি দেশজুড়ে বয়ে যায় কান্না ও শোকের অনিঃশেষ করুণ মাতম।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন