সেভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে সারাবিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে কর্তৃত্ব করে আসছে। সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসী নীতি নিয়ে একের পর এক দেশ তছনছ করে দিয়েছে। মার্কিন অপশক্তির এই আগ্রাসী নীতির কারণে গোটা আরব বিশে^ নেমে এসেছে অশান্তি। ইতিমধ্যে এই দেশটির ষড়যন্ত্র আর লোভের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানের মতো দেশ। সাদ্দাম, গাদ্দাফির মতো একনায়ক শাসকদেরও পতন হয়েছে এই আমেরিকার হাতে। কেউই এই আমেরিকাকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। মনে করা হতো আমেরিকা এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি। এই শক্তিকে দমিয়ে দেয়ার মতো কোনো দেশ নেই। কিন্তু ইরানি জেনারেল সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পরে মনে হচ্ছে আমেরিকার সেই দর্প চূর্ণ হতে যাচ্ছে। কারণ সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধের অংশ হিসেবে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে সেই হামলা রুখতে পারেনি আমেরিকা। ইরানি অস্ত্রের কাছে ধরাশায়ী আমেরিকা ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির ক্ষত বুকে নিয়ে ইতিমধ্যে কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই ইরানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতায় বসতে রাজি হয়েছে। ৯ জানুয়ারি জাতিসংঘে পাঠানো এক চিঠিতে মার্কিন দূত কেলি ক্রাফট জানান, ঘটনা আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আগে এবং বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই তেহরানের সঙ্গে সমঝোতা চায় ওয়াশিংটন। এছাড়াও চিঠিতে “আত্মরক্ষার জন্যে” ইরানি কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে বলে যুক্তি তুলে ধরা হয়। তবে, জাতিসংঘের ইরানি রাষ্ট্রদূত মাজিদ তাখত রাভাঞ্চি জানান, ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার পরও যুক্তরাষ্ট্রের এমন প্রস্তাব “অবিশ্বাস্য”।
সোলাইমানিকে হত্যার নেপথ্যে কী?
ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কুদস ব্রিগেডের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনায় সারাবিশ্বে তোলপাড় চলছে। বিশ্বের বহু মানুষ যেমন শোকে বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন, তেমনি তারা বিস্মিত। ।
জেনারেল সোলাইমানি মূলত সারাজীবনই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। বিশেষ করে ২০১১ সালে যখন সিরিয়ায় উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে আমেরিকা, ইসরাইল এবং তাদের পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক মিত্ররা লেলিয়ে দিয়েছিল তখন যার নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিরোধ ফ্রন্ট গড়ে তোলা হয়েছিল তিনি জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। তিনিই ছিলেন সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের সম্মুখভাগে। তিনি ইরাক এবং সিরিয়াতে উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস’র বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন।
আমেরিকা শুরু থেকেই দাবি করে আসছে তারা আইএস’র বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই জায়গা থেকে আবারও প্রশ্ন উঠছে- আমেরিকা যদি আইএস’র বিরুদ্ধে লড়াই করে তাহলে কেন সেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সম্মুখভাগে থেকে লড়াই করা জেনারেল সোলাইমানিকে আমেরিকা হত্যা করল? অনেকে প্রশ্ন করছেন- কেন আমেরিকা এই সময় জেনারেল কাসেম সোলাইমানির মতো একজন আন্তর্জাতিক সমর কুশলবিদ ও সেনানায়ককে হত্যা করল?
সোলাইমানি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা, ইসরাইল এবং তাদের বিশাল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে প্রচণ্ড রকমের একটি বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। বিরাট একটি শক্তির পক্ষ থেকে ইরাক, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লেলিয়ে দিয়ে এবং যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যে কূটকৌশল বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিল সেই পরিকল্পনা এক কথায় নস্যাৎ করে দিয়েছেন জেনারেল কাসেম সোলাইমানি।
ইরানের এই জেনারেলের কারণে আমেরিকা, ইসরাইল এবং তার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যে বহু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছিল না। ফলে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি আমেরিকা, ইসরাইল এবং তাদের পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক মিত্রদের মাথাব্যথার অনেক বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা এবং ইসরাইলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে নিঃসন্দেহে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি একটি বড় বাধা ছিলেন।
দীর্ঘ চার দশক ধরে আমেরিকা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় রেখে সারাবিশ্বে ইরানকে কোণঠাসা করে ফেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইরান তার কূটনৈতিক সততা ও দক্ষতা দিয়ে ধীরে ধীরে সংকট কাটিয়ে উঠেছে বরং এখন আমেরিকাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এ কারণেই পরমাণু চুক্তি থেকে আমেরিকা সরে গেলেও তারই ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপের দেশগুলো কিন্তু ইরানের সঙ্গে চুক্তি থেকে সরে যায়নি। পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুই দেশ ইরানকে গত দুই দশক ধরে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে এবং এ দুটি দেশ এখন ইরানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মিত্র। রাশিয়া এবং চীন ইরানের যেমন অর্থনীতিক মিত্র, তেমনি রাজনৈতিক মিত্র। সামরিক দিক দিয়ে তার চেয়েও সম্ভবত বড় মিত্র হতে চলেছে। কারণ আগামী অক্টোবরে ইরানের ওপর থেকে জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। তখন ইরান অস্ত্র রফতানি করতেও সক্ষম হবে আবার যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে রাশিয়া এবং চীনের কাছ থেকে তার সুবিধা মতো অস্ত্র কিনতে পারবে। এখানেও জেনারেল সোলাইমানির কূটনৈতিক কার্যক্রমের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। এর পাশাপাশি সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেন ইস্যুতে ইরানি কৌশলের কাছে আমেরিকা দারুণভাবে আটকে গেছে। এসব দেশে মার্কিন কৌশল বারবার যেমন মার খেয়েছে, তেমনি ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, ফিলিস্তিন প্রতিটি দেশে মার্কিন ও ইসরাইল-বিরোধী শক্তিশালী প্রতিরোধ সংগঠন গড়ে উঠেছে। এসব দেশের সাধারণ মানুষও দিনদিন প্রচণ্ডভাবে মার্কিনবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। আমেরিকা, ইসরাইল ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের মিলে ‘নিউ মিডলইস্ট প্ল্যান’ বাস্তবায়নের চেষ্টা করে আসছে তা ব্যর্থ করে দিতে ইরান এবং এই প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলো খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার এই অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য জেনারেল সোলাইমানির মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিত্বকে হত্যা করা আমেরিকা ও ইসরাইলের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো।
সম্প্রতি সৌদি আরবের আরামকো তেল স্থাপনায় যে হামলা হয়েছে তা সম্মিলিতভাবে ঠেকাতে পারেনি আমেরিকা এবং সৌদি আরব। ওই হামলার দায়িত্ব ইয়েমেনের হুতিরা স্বীকার করলেও সৌদি আরব এবং আমেরিকা বলেছে- ইরান এই হামলা চালিয়েছে। আর হুতিরা দাবি করেছে তারা ড্রোন হামলা চালিয়ে আরামকোকে বিধ্বস্ত করেছে। এখন ইয়েমেনের হুতিরা ড্রোন হামলা চালিয়ে থাকুক অথবা ইরান ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাক- যাই ঘটুক না কেন আমেরিকা এবং সৌদি আরবের সামরিক বাহিনী এবং তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যে ওই হামলা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে সেটি পরিষ্কার।
সৌদি আরবের হাতে যত সামরিক সরঞ্জাম এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তার বেশিরভাগই আমেরিকার তৈরি। তার অর্থ দাঁড়ায় ইরান অথবা হুতিদের হামলা মোকাবিলা করতে মার্কিন প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্ষম নয়। এছাড়া ওই তেলক্ষেত্রগুলোর প্রতিরক্ষার দায়িত্বও মার্কিনীদের হাতে ছিলো। এতে সারাবিশ্বে আমেরিকার রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সৌদি আরবও মার্কিনীদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকার দুর্বলতা দেখে এবং নিজেদের বাঁচাতে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। জেনারেল সোলাইমানি এর মধ্যস্থতায় ছিলেন। সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গোপনে তিনি বৈঠকও করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরব আমেরিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। ফলে সোলাইমানিকে হত্যাই তাদের একমাত্র পথ হয়ে ওঠে।
মৃত্যুতেও সফল সোলাইমানি
কিছুদিন আগে সৌদি আরবের আরামকো তেল কোম্পানিতে দেশের বাইরের হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা সৌদি ও মার্কিন উভয় দেশের অস্ত্র সক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। সোলাইমানির হত্যার অভিঘাতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে ইরাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকে দখলদারির আইনগত ভিত্তি যে চুক্তি, ইরাকি পার্লামেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে তা বাতিলে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সরকারের জন্য এই আহ্বান যদিও বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু ঘটনাবলি সেদিকেই যাচ্ছে। অন্তত এই প্রস্তাব পাশের পর ইরাকে আমেরিকান সেনারা রাজনৈতিকভাবে অবৈধ হয়ে গেল। আইনগত অবৈধ ঘোষণার আগেই যদি কোনো ইরাকি আমেরিকানদের ওপর হামলা করে, তাকে বিচারের মুখোমুখি করা রাজনৈতিক চাপের কারণেই কঠিন হবে। আর চুক্তি বাতিল হওয়া মাত্রই ইরাকের মাটিতে প্রতিটি আমেরিকান প্রাণ আক্রমণের বৈধ ও আকর্ষণীয় নিশানা বলে গণ্য হবে। ট্রাম্পের কারণেই ইরাকের আরও নিকটজন হয়েছে ইরান। ইরাকে আমেরিকার বেশির ভাগ কাজই বুমেরাং হয়েছে। যেমন জর্জ বুশ ইরাক দখলে নিলেও দেশটির নেতৃত্ব চলে গেছে ইরানপন্থী শিয়া গোষ্ঠীগুলোর কাছে। এদিকে সোলাইমানিকে হত্যা করে তার আরাধ্য কাজ সেরে দিচ্ছেন ট্রাম্প। বর্তমান ও বিগত তিন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যে শয়তান চক্রের (অ্যাক্সিস অব এভিল) ভয় মার্কিন নাগরিকদের দেখাতেন, সোলাইমানির মৃত্যুর বদলায় সেই চক্র এবার সত্যিই সংগঠিত হয়েছে। এক সারিতে আমেরিকার মুখোমুখি ইরান-ইরাক-সিরিয়া-হিজবুল্লাহ এবং তাদের অধীন অজস্র ছোট-বড় যোদ্ধা গোষ্ঠী। মরণেও সোলাইমানি তার কাজ করে যাচ্ছেন। ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের মুখস্থ হুমকির বুলি এখন ইরাকের বিরুদ্ধে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। কারণ ইরানের হয়ে ইরাকও এখন তার দেশ থেকে মার্কিন সেনা সরানোর দাবিতে সোচ্চার। ইরাকের পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের পর জার্মানি ইরাক থেকে কিছু সৈন্য ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে পুতিন সফর করছেন তুরস্ক, বসেছেন এরদোগানের সঙ্গে। তার আগে সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সঙ্গেও তার বৈঠকের খবর গণমাধ্যমে এসেছে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও চমকপ্রদ। ইরাকের প্রভাশালী ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল সদর তার সদর-সেনাদের আবার সক্রিয় করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই ব্যক্তি ইরাকে বিপুল জনপ্রিয়। তার হুকুমে চলে বিরাটসংখ্যক যুবকের এক বাহিনী। সোলাইমানির ইরাকি সহযোদ্ধা মোহানদিস নিহত হলেও মোহানদিসের মিলিশিয়া বাহিনী এখন সদর-সেনাদেরও পাশে পাবে। সোলাইমানি আরবজুড়ে যে মার্কিনবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক জোট গঠনের কাজে অনেক দূর এগিয়েছিলেন, তাঁর লাশ সামনে রেখে সেই জোট আরও শক্তিশালীই হলো।
বিশ্বাসঘাতকতার শিকার সোলাইমানি
সবারই প্রশ্ন ছিল, সোলাইমানি কেন এ রকম প্রকাশ্যে ইরাকে চলাফেরা করছিলেন? এতই দুর্র্ধষ যদি তার নেটওয়ার্ক, তাহলে কেন বিপদের কোনো আভাসই ইরানিরা পায়নি? গুমরটা ফাঁস করেছেন ইরাকের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আদিল আবদুল-মাহদি। কোনো সামরিক নেতা হিসেবে নয়, সোলাইমানি ইরাকে এসেছিলেন কূটনৈতিক পাসপোর্টে, রাষ্ট্রীয় সফরে, সাধারণ বিমানে অতিথি হিসেবে। এসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধে। ট্রাম্প ইরাকি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যাতে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেন। সোলাইমানির জন্য সৌদি আরব সমঝোতার বার্তাও পাঠিয়েছিল। তাই তিনি সশরীরে বাগদাদে এসেছিলেন ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে। ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা আগেই তাকে হত্যা করে শান্তির এই চিকন সুতাটি ছিঁড়ে ফেলা হয়। সুতরাং সোলাইমানি ছিলেন ইরানের সরকারি বার্তাবাহক। যুদ্ধ শাস্ত্রে এবং কূটনীতিতে চিরায়ত একটা নৈতিকতা হলো, বার্তাবাহককে হত্যা না করা। সোলাইমানিকে হত্যা করে আসলে শান্তির বার্তাকেই হত্যা করা হলো। ট্রাম্প যদি হত্যার নির্দেশই দেবেন তাহলে শান্তির উদ্যোগ কেন নিতে বললেন? নাকি সেটা ছিল এক পাতা ফাঁদ। নির্দেশ তিনিই দিন বা দিক রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র, বা ইসরায়েল-ইরানের সঙ্গে শান্তি তারা চায় না। আমেরিকার যে মধ্যপ্রাচ্য-নির্ভরতা, ইরান তাকে কোনোভাবেই মানতে চায় না।
সোলাইমানি হত্যার পরিণতি কী হবে?
এবার এই হত্যাকাণ্ডের পরিণতি কী হতে পারে সেদিকে একটু আলোকপাত করি। জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে ইরান-আমেরিকা যুদ্ধ। এ ধরনের যুদ্ধের কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না এই কারণে যে, জেনারেল সোলাইমানি যেহেতু ইরানের স্বীকৃত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সামরিক বাহিনীর একজন কমান্ডার এবং তিনি যেহেতু ইরান সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অ্যাসাইনমেন্টে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করছিলেন সেহেতু তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চ পর্যায়ের একজন ব্যক্তিত্ব তাতে সন্দেহ থাকার কারণ নেই। এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করার অর্থ হচ্ছে ইরানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং তার পুরো সামরিক বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করা। যখন ইরানের সামরিক বাহিনী বা তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে তখন ইরানকে যুদ্ধের পথে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। ফলে আমেরিকার সঙ্গে ইরানের সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা একটা আছে। তবে একথা ঠিক- ইরানের নেতারা হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। তারা অত্যন্ত বুঝে শুনে পা ফেলবেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অনেক কাজ এখনো বাকি। সিরিয়ার গোলযোগ শেষ হয়নি, সিরিয়ার পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়নি, সিরিয়ায় জবরদখল করে মার্কিন সেনারা ঘাঁটি গেঁড়ে রয়েছে, সিরিয়ার তেল ক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ মার্কিনীদের হাতে। এগুলোর একটা বিহিত করার প্রশ্ন কিন্তু ইরানের সামনে রয়েছে। পাশাপাশি ইরাক এখনো অস্থিতিশীল। যদিও সেখানে সন্ত্রাসীরা আপাতত পরাজিত হয়েছে কিন্তু আমেরিকা এবং ইসরাইলের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। মাঝেমধ্যেই তারা ইরাককে অস্থিতিশীল করে তুলছে। ফলে সেখানে অনেক কাজ বাকি।
সিরিয়া এবং ইরাকে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই অপরিহার্য। এসব দেশে যত দ্রুত অস্থিতিশীলতা দূর করা যাবে ততো দ্রুতই পুরো মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা হবে এবং ইরান অন্য কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে। ইয়েমেন সংকট সমাধানের দিকে নিতে হবে প্রধানত ইরানকেই। সৌদি আরব, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সম্মিলিত ও সর্বাত্মক অবরোধের কবলে পড়ে রয়েছে কাতার। দেশটির পাশে তাৎক্ষণিকভাবে এসে দাঁড়িয়েছে ইরান এবং তুরস্ক। এই কাতারকেও সঙ্গে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন রয়েছে ইরানের জন্য। পাশাপাশি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে সেখানে পুনর্গঠনের প্রশ্ন আছে। সেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার কাজ রয়েছে। এ নিয়ে ইরানের হাতে বহু প্রকল্প। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দরকার ইরানের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি।
এই মুহূর্তে যদি আমেরিকার সঙ্গে ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে এই বৃহৎ কর্মকাণ্ড বাধার মুখে পড়বে। সেক্ষেত্রে ইরান হয়তো এখনই যুদ্ধের পথ বেছে নাও নিতে পারে। কিন্তু আশঙ্কা- আমেরিকা আরও কিছু কাজ করবে যার প্রেক্ষাপটে ইরান হয়ত একটা পর্যায়ে গিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এরইমধ্যে ঘোষণা করেছেন যে, আমেরিকার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিশোধ নেয়া হবে। ফলে ইরান যদি কঠোর প্রতিশোধ নিতে চায় তাহলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠার কথা বলতেই হবে।
তবে, যুদ্ধে না গিয়েও বিকল্প পথ বেছে নিতে পারে ইরান এবং এই সম্ভাবনাই বেশি। সেই বিকল্প পথ হতে পারে এমন যে, পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে মার্কিন সেনাদের জন্য মারাত্মকভাবে অনিরাপদ করে তোলা। ইরানের প্রতি অনুগত মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি প্রতিরোধকামী সংগঠনের সঙ্গে জেনারেল কাসেম সোলাইমানির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্ক মূলত ইরানেরই সম্পর্ক। জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করার কারণে বিভিন্ন সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারে। ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মার্কিন সেনাঘাঁটিতে বোমা হামলা হয়েছিল। সেই হামলায় আমেরিকার ২৪১ জন এবং ফ্রান্সের ৫৮ জন সেনা নিহত হয়। শুধু লেবাননে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন সেনারা এ ধরনের হামলার শিকার হয়েছে।
জেনারেল কাসেম সোলাইমানির হত্যার পর প্রচলিত যুদ্ধের পথ অনুসরণ না করে ইরান এবং তাদের প্রতি অনুগত সংগঠনগুলো অপ্রচলিত যুদ্ধের পথও বেছে নিতে পার। অবশ্যই একথা ঠিক যে, জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যে পথ দেখিয়ে দিয়েছে আমেরিকা, ইরান সে পথে হাঁটবে এবং সে পথ অবশ্যই হবে প্রতিরোধ এবং প্রতিশোধের পথ।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইরানি জেনারেলের পাশাপাশি নিহত হয়েছেন ইরাকের জনপ্রিয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিট বা হাশ্দ আশ-শাবির সেকেন্ড ইন কমান্ড আবু মাহদি আল মুহান্দিস। তার সংগঠন ইরাক সরকারের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ। তাদের দলের অনেকেই সংসদ সদস্য। এছাড়া, ইরাকে আইএস বা দায়েশ নামক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ হয়েছে তাতে এই পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিট সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ফলে আবু মাহদি আল-মুহান্দিস এবং তার সংগঠন ইরাকের জনসাধারণ বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। ফলে তার এই হত্যাকাণ্ড ইরাকের জনগণের মেনে নেয়ার কোনো কারণ নেই, মেনে নেবে না পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটও। তারাও এর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে। এরইমধ্যে ইরাক সরকার বলেছে, কাসেম সোলাইমানি এবং আবু মাহদি আল-মুহান্দিসের ওপর হামলা চালিয়ে আমেরিকা তাদের সেনাদের ইরাকে থাকার চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
ইরাকের অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা মুক্তাদা আল-সাদর। তিনি তার শিয়া মিলিশিয়াদেরকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এই অবস্থায় এমন ধারণা করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে যে, ইরাকে মার্কিন দূতাবাসে আবার হামলা হতে পারে এবং ১৯৭৯ সালে ইরান থেকে যেভাবে দূতাবাস গুটিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল মার্কিন সরকার, ইরাক থেকেও সম্ভবত তারা সেই কাজ করতে বাধ্য হবে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমেরিকা যা করেছে তাতে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। লেবাননের হিজবুল্লাহ প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। একই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে ইয়েমেনের হুতি আনসারুল্লাহ আন্দোলন। ফিলিস্তিনের হামাস এবং ইসলামি জিহাদ আন্দোলন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। হামাস জানিয়েছে, তাদেরকে আজকের এই শক্তিশালী অবস্থানে আনার পেছনে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি বিরাট বড় অবদান রেখেছেন। ফলে সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা আজকের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি খারাপ অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে- একথা বলা যেতেই পারে। দিন দিন যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠবে। সেই প্রতিরোধের সামনে সম্ভবত আমেরিকা টিকতে পারবে না।
মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর ইরান এবং আমেরিকার চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে যদি যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে তার সর্বব্যাপী প্রভাব ঠেকাতে পারবে না আমেরিকা। পুরো মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকার জন্য বারুদের কু লীতে পরিণত হবে। পাশাপাশি পারস্য উপসাগরে সব ধরনের জাহাজ চলাচল অনেক বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠবে। এমনকি পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালিতে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে সারাবিশ্বে বিশেষ করে তেলের বাজারে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং তেলের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এ মুহূর্তে ধারণা করাও কঠিন। ফলে সারাবিশ্বে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবে তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাল দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। ফলে আমি মনে করি, আমেরিকার পক্ষ থেকে এই সংকট বাড়ানো আর মোটেই ঠিক হবে না। জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার ভেতর দিয়ে তারা যে অন্যায় করেছে তার খেসারত আমেরিকাকে দিতে হবে। সেই খেসারত কিভাবে কমানো যায় সেদিকেই বরং আমেরিকার মনোনিবেশ করা উচিত।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ২০ জানুয়ারি ২০২০ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন