‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ লক্ষ্যে সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলন চাইছে বিএনপি। দলটি আলাদাভাবে আন্দোলনে থাকবে। পাশাপাশি থেকে ২০ দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বামপন্থী দলগুলো যাতে পৃথকভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামে, সেই চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর মধ্যে কিছুটা আগ্রহ থাকলেও বাম দলগুলোর মধ্যে কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে। দু-একটি বাম দলের বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সমঝোতা করে মাঠে নামতে আপত্তি নেই। তবে সিপিবিসহ কয়েকটি দল দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরে বামদের একটি বিকল্প শক্তির উত্থানের পক্ষপাতী। অবশ্য যুগপৎ আন্দোলনের অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বিএনপিকে তারা আগে আন্দোলনে নামার পরামর্শ দিচ্ছে। দলগুলো বলছে, আন্দোলনের একপর্যায়ে পরিস্থিতি সে রকম হলে সবার গতি বা রাস্তা এক হয়ে যেতে পারে। এ জন্য আগে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের মধ্যে এ প্রশ্নে এখনো আলোচনাই হয়নি। এই জোটের দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহও কম। কারণ দলগুলো আন্দোলনের জন্য বিএনপির ওপরই নির্ভরশীল। তবে কোনো বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা না হলেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর নেতারা বিএনপির এই তৎপরতা সম্পর্কে জানেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলন বিএনপির তুলনায় জনগণই এখন বেশি চায়। তা ছাড়া সরকারের বাইরে থাকা সব দলই এখন মনে করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।’ প্রশ্ন উত্থাপন করে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব কি শুধু বিএনপির একার? তার মানে কি অন্য দলগুলো গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছে?’ তিনি বলেন, ‘আমি বলব, বিএনপিকে দোষ দিয়ে অনেক সময় পার হলো। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সরকারের বিরুদ্ধে এখন সবারই মাঠে নামা উচিত।’
সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি নিজে আগে রাস্তায় নামুক। তারা বড় দল। কোনো একটা পয়েন্টে গিয়ে পথ এক হয়ে যেতেও পারে। কিন্তু আলোচনা বা সমঝোতা করে বিএনপির সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক মেরুকরণে যুক্ত হব না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একটি আপদ, অন্যটি বিপদ। বিএনপি গদির জন্য রাজনীতি করে, নীতির জন্য করে না।’
২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে জানান, জোট করাই হয়েছে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য। বিএনপির উদ্যোগ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যুগপত্ভাবে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের চিন্তা বিএনপির ভেতরে থাকলেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে আমরা তো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ আন্দোলনে আছি।’
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বামপন্থী বারোটি দল তো আন্দোলনের জন্য এক হলো। এটা একটি অগ্রগতি। এখন আমরা (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) তাদের সঙ্গে শেয়ার করব।’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলন প্রশ্নে বিএনপির উদ্যোগকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।’ তাঁর মতে, ‘বিএনপিকে দোষ দিয়ে অনেক সময় পার হলো!’
বাম গণতান্ত্রিক জোটের আটটি দল ছাড়াও আরো চারটি দলের সমন্বয়ে গত বুধবার এক বৈঠকে বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হয়। ‘দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের মুক্তির লক্ষ্য’ নির্ধারণ করে ওই আলোচনায় দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতারা বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়ে একমত হন। দলগুলোর বেশ কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই বৈঠক এক ধাপ অগ্রগতি। তাঁরা জানান, বিএনপির লক্ষ্যও যেহেতু গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, সেই অর্থে বিএনপির কাছেও এই বৈঠকের তাৎপর্য রয়েছে। বিএনপির পাশাপাশি এই দলগুলোর দু-একজন নেতাও স্বীকার করেন, ভবিষ্যৎ সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ আছে।
তবে সিপিবিসহ বেশ কয়েকটি দল এ প্রশ্নে কট্টর বিরোধী অবস্থানে থাকায় বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন দূরে থাক, যুগপৎ আন্দোলনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা মূলত দুই ইস্যুতে কথা তুলছে। প্রথমত, জামায়াত এখনো বিএনপি সঙ্গে আছে এবং দ্বিতীয়ত, বিএনপির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এখনো এককেন্দ্রিক নয় বলে তারা মনে করে। সূত্র মতে, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ঢাকার বিএনপি নেতাদের সিদ্ধান্তের সমন্বয় আছে কি না—এ প্রশ্ন উঠছে ওই দলগুলোর মধ্যে। সূত্রগুলো জানাচ্ছে, অনানুষ্ঠানিক আলোচনা কিছু দূর এগোলেও এই দুই ইস্যুতে গিয়ে সব কিছু থেমে যাচ্ছে।
প্রবীণ বামপন্থী নেতা, বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের কথা বাইরে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বাম দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হলে দু-একটি পয়েন্ট তো উঠতেই পারে।’ তিনি বলেন, ‘আগে বিএনপি মাঠে নেমে দেখাক না যে তারা আন্দোলন চায়। তারপর আমরা দেখব আন্দোলনের কী হয়। কিন্তু আলোচনার টেবিলে সমঝোতা করে আন্দোলন হয় না।’
গণসংহতি আন্দোলনের জুনায়েদ সাকি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে থেকে স্বাক্ষর বা সমঝোতা করে আন্দোলন হয় না। রাজপথের আন্দোলনই বৃহত্তর ঐক্যের পথ সৃষ্টি করবে। কিন্তু বিএনপি তো এখন পর্যন্ত প্রমাণই করতে পারেনি যে তারা আন্দোলন করবে।’ ‘তা ছাড়া বিএনপি তো এখন পর্যন্ত জামায়াতকেই ছাড়তে পারেনি। তারা ২০ দল পুনর্গঠন করতে পারেনি। ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেও তারা আন্দোলনে নামেনি’, বলেন তরুণ এই বামপন্থী নেতা।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল উভয় জোটেই বিএনপি সবচেয়ে বড় দল। দলটির নেতাকর্মীদের উপস্থিতির ওপরই ওই দুই জোটের কর্মসূচি সফল হওয়া নির্ভর করে। বামপন্থীদের সঙ্গে সমঝোতা হলেই কেবল এই দুই জোটের দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে বিএনপি।
তবে বিএনপির কাছে ২০ দলের গুরুত্ব এখন অনেকটাই কমে গেছে। কারণ এরই মধ্যে এই জোট থেকে বেরিয়ে গেছে বিজেপি। অন্য দলগুলোর মধ্যে এলডিপি ও কল্যাণ পার্টিসহ ছোট কয়েকটি দল জোটে থাকার ঘোষণা দিলেও তারা ড. অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় মুক্তমঞ্চে’ যোগ দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীও ওই মঞ্চে কিছুদিন কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে এখন বিরত আছে। তবে জোটের সবচেয়ে বড় দল জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক এখন তত ঘনিষ্ঠ নয়। ফলে তারা ওই উদ্যোগ সম্পর্কে জানেও না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে বিএনপির উদ্যোগ সম্পর্কে জানা নেই। আবার এ নিয়ে জানার আগ্রহও নেই।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক এখন সুখকর বা বিদ্বেষপ্রসূত কোনোটিই নয়।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন