সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের আগে অত্যন্ত শক্তিশালী সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুললেও, সেই আন্দোলনে সাফল্য মেলেনি। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতেও সরকারের ভিত নড়েনি। এর পরপরই সব ধরনের জোরালে আন্দোলন কর্মসূচি থেকে বলতে গেলে নিজেদেরকে গুটিয়েই নেয় বিএনপি। এমনকি দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি করার পরেও বিএনপির পক্ষ থেকে জোরালো কোনো আন্দোলন কর্মসূচি দেয়া হয়নি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় ২ বছর ধরে বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি রয়েছেন। এরমধ্যে তাকে মুক্ত করার জন্য বিশেষ কোনো কর্মসূচি দলের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। শুধু তাই নয় খালেদা জিয়াকে বন্দি রেখে ৩০ ডিসেম্বরের বিতর্কিত নির্বাচন করা হলেও কোনো ধরনের আন্দোলনে যায়নি বিএনপি। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার মতো ডজন ডজন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু পেয়েও একেবারেই বলা যায়, নীরব ভূমিকায় ছিলো দলটি। কিন্তু প্রায় ৫ বছরের সেই নীরবতা ভেঙে কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়ার জামিনকে ঘিরে হঠাৎ করেই চাঙ্গা হয়ে উঠেছে বিএনপি।
গত ২৬ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে মুক্তিযোদ্ধা দলের অনুষ্ঠান শেষে বড় একটি মিছিল বের হয় এবং সুপ্রিম কোর্টের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া না হলে সরকার পতনের একতরফা আন্দোলনের ঘোষণাও আসে বিএনপির পক্ষ থেকে। শুধু তাই নয় সভা সমাবেশের জন্য কোনো ধরনের পুলিশি অনুমতিরও তোয়াক্বা করা হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়। তার পরেই ঘটলো ৫ ডিসেম্বরের ঘটনা। খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি পিছিয়ে দেয়াকে কেন্দ্র করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এজলাসে প্রধান বিচারপতির সামনে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের প্রতিবাদ ও হট্টগোল দেশবাসীকে আরো বেশি চমকে দিয়েছে। এদিন গোটা সুপ্রিম কোর্ট জুড়ে দফায় দফায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এমনকি নজিরবিহীনভাবে এজলাসে অবস্থান করে কয়েক ঘণ্টার জন্য আপিল বিভাগের কার্যক্রমও স্থবির করে দেন তারা। ইতিমধ্যে খালেদা জিয়ার জামিন শুনানির প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে বিএনপি। সারাদেশের আদালতগুলোতেও আইনজীবীদের লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়ার জামিনকে ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। হুমকি-পাল্টা হুমকি চলছে বিএনপি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মধ্যে। ক্ষমতাসীন দলের একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি নৈরাজ্য করলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে? সরকারের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিই বা কেন এতো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে বিশ্লেষকরা নানাভাবে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। তারা বলছেন, প্রায় ৫ বছর ধরে আন্দোলনের বাইরে থাকা বিএনপি সমগ্র রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন পর্যবেক্ষণ করেছে, তেমনি শক্তি ক্ষয় না করে ভেতরে ভেতরে দলকেও সুসংগঠিত করেছে। একইসঙ্গে এই সরকারের বিরুদ্ধে বিগত দিনে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংগ্রাম করেও কি কারণে বার বার ব্যর্থতা এসেছে; সেইসব কারণও নিরূপণ করেছে। এবার সেই ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমেছে বিএনপি। দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যেমন এই আন্দোলনের টার্গেট তেমনি সরকার পতনের মতো আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যও রয়েছে। তবে এই টার্গেট সফল হবে কি না তা বিশ্বাস করতে হলে; বিএনপির সক্ষমতা বা নেপথ্যের শক্তিও বিশ্লেষণ করতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি শুধুমাত্র একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা বা নিজেদের বিশাল ত্যাগী কর্মীবাহিনীর উপরে নির্ভর করেই এবার মাঠে নামেনি। বিভিন্ন বলয় থেকে তারা শক্তি ও সাহস সঞ্চার করেছে। এরমধ্যে বৈদেশিক শক্তি অন্যতম। ইতিমধ্যে ভারত সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের যে একটি শীতল সম্পর্ক চলছে, সেই খবর বিএনপির কাছে রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে ভারতের অনেক অযৌক্তিক চাহিদা পূরণ করেছে। সর্বশেষ বিনাশুল্কে ভারতকে সড়ক পথ ব্যবহার, এমনকি বন্দর ব্যবহারেরও সুযোগ দেয়া হয়েছে। তারপরও কেন যেন তাদের খুশি করা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে নানা অস্বস্তি এবং সংশয় প্রকাশ পাচ্ছে। কিছুদিন আগেও দুইদেশের শীর্ষনেতারা বলেছিলেন যে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন সবচেয়ে সুখকর সময় কাটাচ্ছে এবং দুইদেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা প্রবাহ ইঙ্গিত করছে যে সেই সম্পর্ক এখন আগের জায়গায় নেই। সম্পর্কে কিছু টানাপোড়েনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও ভারত এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হচ্ছে যে সম্পর্কে কোনো টানাপোড়েন নেই। টুকটাক সমস্যা রয়েছে, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
কিন্তু কূটনৈতিক সূত্রে বলা হচ্ছে যে, কয়েকটি ঘটনায় বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্কের মধ্যে অস্বস্তি এবং সংশয় দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে দিল্লী সফর একটি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত অক্টোবরে দিল্লী সফর করেন। নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাগ্রহণের পর এটি ছিল শেখ হাসিনার প্রথম দিল্লী সফর। এই সফরকে ঘিরে দুই দেশেরই আগ্রহ ছিল অনেক। কিন্তু এই সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ গুরুত্ব এবং মর্যাদা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে, এর আগে প্রথম মেয়াদে নরেন্দ্র মোদি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন যেমন শেখ হাসিনা দিল্লীতে গেলে সমস্ত প্রটোকল ভঙ্গ করে মোদি শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, এবার সেরকম কিছুই ঘটেনি। এবার পুরো সফরের মধ্যে কোথায় যেন আন্তরিকতার অভাব ছিল।
কলকাতা সফরেও এর প্রকাশ ঘটেছে। সৌরভ গাঙ্গুলী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হওয়ার পর ইডেনে ভারত বাংলাদেশ দিবা-রাত্রির টেস্টের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রী সেই আমন্ত্রণে সাড়া দেন। ২২ নভেম্বর সকালে তিনি ঝটিকা সফরে কলকাতা যান। কিন্তু কলকাতায় যেভাবে তাকে প্রটোকল দেওয়া হয়েছে বা তার সাথে আচরণ করা হয়েছে তা নিয়ে ক্ষুব্ধ ভারতের গণমাধ্যমই। আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া সবাই সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়নি বলে সমালোচনা করেছেন। একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন কলকাতায় গেলেন তখন কেন্দ্রীয় সরকারের কেউ তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাবে না এটা নজিরবিহীন বলেও ভারতীয় গণমাধ্যম বলেছে। কলকাতার পুরো সফরটিতে আওয়ামী সভাপতি শেখ হাসিনাকে যথাযথ সম্মান মর্যাদা দেওয়া হয়নি বলেও অনেকে মনে করছেন।
এছাড়া রয়েছে পেঁয়াজ সংকট। বাংলাদেশে যখন পেঁয়াজ সংকট শুরু হলো সেই সংকটের মূল কারণ ছিল ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করা। এই ঘোষণার পরই বাংলাদেশে লাফিয়ে লাফিয়ে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। যদিও অক্টোবরের দিল্লী সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেঁয়াজ কুটনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন। সে সময় তিনি অনুযোগ করে বলেছিলেন, এভাবে হুট করে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় বাংলাদেশ কিছুটা সমস্যায় পড়েছে। কিন্তু এরপরও ভারতের মন গলেনি। ভারত এখন পর্যন্ত তাদের রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। ফলে পেঁয়াজের দাম এখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অনেক কূটনৈতিক মনে করেন যে, পেঁয়াজ সংকটটা ভারত ইচ্ছে করেই সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের ওপর একটি চাপ প্রয়োগের জন্য। কিন্তু কেন বাংলাদেশের ওপর এমন হঠাৎ করে চাপ প্রয়োগের অভিপ্রায় ভারতের হলো সে বিষয়টি এখনো অজানা।
পুশ ইন : নাগরিকপঞ্জির অনুজাত তুলে হঠাৎ করেই বেশ কয়েকটি ঘটনায় বাঙালিদের আটক করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ঘটনাটি এমন এক সময় ঘটেছে যখন প্রধানমন্ত্রী তার কয়েকদিন আগে কলকাতা সফর করে এসেছেন। এই সময়ে হঠাৎ করে পুশ ইন কেন তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন। যদিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুশ ইনের ব্যাপারে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানে না। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারিভাবে কিছু জানুক আর নাইবা জানুক পুশ ইনের ঘটনায় পুরো বাংলাদেশে একটা অস্থিরতা এবং সংশয় তৈরি হয়েছে। কিছুদিন আগে আসামের নাগরিকপঞ্জির সময় থেকেই যে অস্বস্তি শুরু হয়েছিল তা এখন উদ্বেগের পর্যায়ে চলে গেছে।
ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারা কেউ কেউ স্পষ্ট বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলেছেন। কোন কোন বিজেপি নেতা বলেছেন যে, সারা ভারতেই নাগরিকপঞ্জী হবে এবং যত বাংলাদেশ থেকে আগত আছে তাদের বাংলাদেশে বিতাড়িত করে দেওয়া হবে। এরকম দায়িত্বহীন মন্তব্যের পরও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
কাজেই কূটনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে যে, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক যে উচ্চতায় উঠেছিল তা এখন নামতে শুরু করেছে। কিন্তু কেন নামছে সে ব্যাপারে কোন সদুত্তর নেই।
শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের এই সম্পর্ককেও নিজেদের পুঁজি হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। আর দেশটির বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে দলীয়ভাবে সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টাতো দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে বিএনপির।
এছাড়া ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছে। দলীয় প্রধানের জামিনকে কেন্দ্র করে বিএনপির এই চাঙ্গা হওয়ার নেপথ্যে দেশগুলোর গ্রিন সিগন্যাল থাকতে পারে বলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ইতিমধ্যে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা বিষয়ক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে এসে ঢাকায় সরকারের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন পেন্টাগনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা র্যান্ডল শ্রাইভার। ট্রাম্প প্রশাসনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (প্রতিরক্ষা বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী) শ্রাইভার প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সঙ্গেও পৃথক পৃথক বৈঠক করেছেন। সূত্র জানিয়েছে, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের আয়োজনে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও পেন্টাগন কর্মকর্তার বৈঠক হয়েছে। এইসব বৈঠকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যু নিয়েও কথা হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েই লন্ডনে ৩ মাসের সফর শেষে দেশে ফিরেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর থেকে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি মামলার বিচার কাজ এগিয়ে নিতেই তিনি সহযোগিতা করেছেন। নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিয়েছেন, শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। যদিও এই মামলায় শেষ পর্যন্ত যে কারাবরণ করতে হবে সেই ধারণা খালেদা জিয়ার ছিলো। কিন্তু আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তারপরেও তিনি আদালতে হাজির হয়েছেন। শেষপর্যন্ত কারাবরণও করেছেন। সূত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে আশ^াস দেয়া হয়েছিলো বেশি দিন তাকে কারাভোগ করতে হবে না। সংসদ নির্বাচনের আগেই তিনি মুক্ত হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এরপর একাধিকবার বিদেশ যাওয়ার শর্তে তার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি এসেছে। কিন্তু তিনি জামিন ছাড়া প্যারোলে মুক্তি নিতে একেবারেই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তবে এই মুহূর্তে শারীরিক পরিস্থিতির কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন। যে কারণে কোনোভাবেই দলের নেতাকর্মীরা আর ঘরে বসে থাকতে রাজি নন। যে কোনোভাবেই হোক খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে আপোষহীন হয়ে উঠেছেন তারা।
প্রধান বিচারপতির এজলাসে আসলে কি ঘটেছিলো?
গত ৫ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি পিছিয়ে দেওয়ার প্রেক্ষাপটে আদালতকক্ষে নজিরবিহীন হট্টগোলের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা মুহুর্মুহু স্লোগান দেন। বিচারপতিদের এজলাস ত্যাগের সময় ‘ধর, ধর’ বলে চিৎকার করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে আদালতকক্ষে তাঁদের অবস্থান ও হট্টগোলের কারণে আপিল বিভাগের কার্যক্রমে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
এ পরিস্থিতিকে ‘নজিরবিহীন’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকা দরকার। তবে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা বলেছেন, তাঁদের কথা না শুনেই জামিনের আবেদনের শুনানির সময় এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিলে তাঁরা আইনের ভেতরে থেকে এর প্রতিবাদ করেছেন।
এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, আদালতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানির দিন ধার্য ছিল। শুনানিতে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন দাখিল করারও কথা ছিল। কিন্তু মেডিক্যাল বোর্ড প্রতিবেদন দাখিল না করায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সময়ের আবেদন করেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ আগামী ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি পিছিয়ে ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন।
এর পরই বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মুহুর্মুহু স্লোগান, মাঝে মাঝে সরকার সমর্থক আইনজীবীদের প্রতিবাদের মুখে চরম হৈচৈ-হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। ফলে বিচারকাজ বন্ধ হয়ে যায়। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘খালেদা, জিয়া; জিয়া, খালেদা’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। এ প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি প্রথম ধাপে এজলাস ত্যাগ করেন। পরে সোয়া এক ঘণ্টার বেশি সময় নির্বিকার এজলাসে বসে থাকেন বিচারপতিরা। এসময় অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, এ জে মোহাম্মদ আলী, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ কয়েক শ বিএনপিপন্থী আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ও মমতাজ উদ্দিন ফকির।
দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। এ সময় সরকারপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আব্দুল মতিন খসরু, এ এম আমিন উদ্দিন, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, তানজিবুল আলম, সৈয়দ মামুন মাহবুবসহ শতাধিক আইনজীবী। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়। শুরুতেই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ভিসি বলেছেন, রিপোর্ট প্রস্তুত হয়নি। তাই দুই সপ্তা সময় চাচ্ছি।’
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মেডিক্যাল বোর্ডের একটি রিপোর্ট তো আছে। সেটা দেখতে পারেন।’ তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটা পেলেন কোথায়? এটা তো গোপনীয় প্রতিবেদন।’ জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘যেহেতু আমাদের মাথাব্যথা, তাই আমরা জোগাড় করেছি। আমরা পুরোটাই এনেছি।’ এ কথা বলে রিপোর্টের কপি বিচারপতিদের সরবরাহ করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এই রিপোর্টের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পরে জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘আমরা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বিবেচনায় জামিন চাচ্ছি।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা রিপোর্ট চেয়েছি। আগে সেই রিপোর্ট আসুক। আগামী বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) শুনব।’ প্রধান বিচারপতির এ কথার পর বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা হৈচৈ শুরু করেন। তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আপনাদের (আপিল বিভাগ) প্রতি অনেক আশা। এ কারণে বারবার আপনাদের কাছে আসি।’ এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি পরবর্তী দিন ধার্য করে আদেশ দেন। এরপর জয়নুল আবেদীন শুনানির দিন এগিয়ে রবিবার বা সোমবার করার জন্য বারবার অনুরোধ জানাতে থাকেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি আদেশ দিয়ে বলেন, ‘কোনো বিলম্ব ছাড়াই ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করতে হবে। ১২ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানি।’
তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, তারা (রাষ্ট্রপক্ষ) সব সময় যা বলছে আপনারা সেভাবেই বিশ্বাস করছেন এবং আদেশ দিচ্ছেন। গতকাল (বুধবার) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া রাজার হালে আছেন।’ এ সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ‘শেম, শেম’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। সরকার সমর্থক আইনজীবীরাও পাল্টা প্রতিবাদ জানান। শুরু হয়ে যায় হট্টগোল। এ সময় প্রধান বিচারপতি মামলা শুনতে অপারগতা জানান।
খালেদা জিয়াকে সশরীরে আদালতে হাজির করা হোক : শুনানিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের উদাহরণ টেনে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, তাঁর (নওয়াজ) শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে বিদেশে পাঠানো হয়েছে চিকিৎসার জন্য। ওই দেশের বিচার বিভাগের চেয়ে আপনারা শক্তিশালী। তাই আপনারাও এ রকম একটা আদেশ দিতে পারেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের কথা যদি বিশ্বাস না করেন তবে একটা আদেশ দিন যে খালেদা জিয়াকে সশরীরে আদালতে হাজির করা হোক।’
এ সময় খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার খোকন বলেন, ‘এই অ্যাটর্নি জেনারেলের পরামর্শে সরকার চলছে। তাঁর কারণেই খালেদা জিয়াকে তিলে তিলে মেরে ফেলা হচ্ছে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আগে রিপোর্ট আসুক। তখন সব হবে।’
তখন সরকার সমর্থক আইনজীবীরা চিৎকার করে ব্যারিস্টার খোকনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা পাল্টা হৈচৈ করতে থাকেন। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে এমন অবস্থা চলতে থাকায় বিচারপতিরা সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে এজলাস থেকে নেমে যান। এ সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ‘ধর, ধর’ বলে চিৎকার করতে থাকেন।
আদালতকক্ষের পেছনের দিক থাকা বিএনপিপন্থী জুনিয়র আইনজীবীরা সেখানে থাকা সিনিয়র আইনজীবীদের বের হতে বাধা দেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল বের হতে চাইলে তাঁকে জুনিয়ররা বসিয়ে দেয়। আদালতকক্ষ থেকে আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অন্যপক্ষের আইনজীবীরা বের হয়ে যাওয়ার পর বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা পুরো আদালতকক্ষে অবস্থান নেন। তাঁরা বলছিলেন, খালেদা জিয়ার জামিন না হওয়া পর্যন্ত আদালতকক্ষ ছাড়ব না।
বিচারপতিরা এজলাসে চুপচাপ বসে থাকেন : সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অন্য বিচারপতিরা এজলাসে বসেন। এ সময় জয়নুল আবেদীন দাঁড়িয়ে আদালতের আগের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন জানান। কিন্তু প্রধান বিচারপতি সে আবেদনে সাড়া দেননি। তখন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘খালেদা জিয়ার জামিন চাই’। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা এখন আর কিছু শুনব না। অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। এ রকম অবস্থা আমার বিচারিক জীবনে দেখিনি। এটা নজিরবিহীন।’ আইনজীবীরা আবারও হৈচৈ করেন। জয়নুল আবেদীন প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘একটু শুনুন।’ জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন।’ এ সময় জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা নই। প্রধানমন্ত্রী গতকাল বক্তব্য দিয়ে বিচার বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন।’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা কারো কথায় নয়, কাগজ দেখে বিচার করব।’
তখন খালেদা জিয়ার অন্য আরো কয়েকজন আইনজীবী কথা বলতে চাইলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সিনক্রিয়েট করবেন না। সব কিছুরই একটা সীমা আছে।’
দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আরেকটি মামলা শুনানির জন্য আদালতে উপস্থাপন করা হয়। ওই সময় বিএনপিপন্থী সিনিয়র আইনজীবীরা আদালত কক্ষ থেকে বের হতে চাইলে জুনিয়র আইনজীবীরা বাধা দেয়। এরই মধ্যে আদালতে উপস্থাপন করা মামলা শুনানি করতে শুরু করেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি। কিন্তু বিএনপপন্থী আইনজীবীরা বলেন, খালেদা জিয়ার মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো মামলা শুনানি হবে না। এ সময় ব্যারিস্টার তাপস বলেন, ‘আমরা শুনানি করব।’ অন্যদিকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। প্রায় ২০ মিনিট ধরে আজমালুল হোসেন শুনানির চেষ্টা করেন। কিন্তু বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের স্লোগান, হৈচৈ, চিৎকারের কারণে তার শুনানি বাধাগ্রস্ত হয়। ১২টা ৫ মিনিট থেকে তিনি আর শুনানি করতে পারেননি। তখন থেকে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত তিনি ডায়াসে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন। অন্যদিকে বিচারপতিরা এজলাসে চুপচাপ বসে থাকেন। এ অবস্থার মধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আদালত কক্ষ থেকে বের হতে চাইলে বিএনপিপন্থী জুনিয়র আইনজীবীরা বাধা দেন। জুনিয়র এক আইনজীবীকে তিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়ার কথা বলে শেষ পর্যন্ত বের হতে পারেন। তবে কিছুক্ষণ পর আবার আদালত কক্ষে ফিরে আসেন।
চকোলেট-শিঙ্গাড়া বিতরণ : ৫ ডিসেম্বর প্রথম দফায় বিচারপতিরা এজলাস থেকে নেমে গেলে ব্যারিস্টার খোকন বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে চকোলেট বিতরণ করেন। এর কিছুক্ষণ পর শিঙ্গাড়া আনা হয়। তারা আদালত কক্ষে বসেই শিঙ্গাড়া খান। বিএনপির আইনজীবীরা চকোলেট মুখে আদালত কক্ষে অবস্থান করার পাশাপাশি হট্টগোল সৃষ্টি করেন। এজলাস থেকে নেমে যাওয়ার সময় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘সব কিছুর সীমা থাকা উচিত। আপনারা এজলাসকক্ষে যে আচরণ করেছেন, তা নজিরবিহীন।’
আদালত থেকে বেরিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট চত্ত্বরে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এরপর এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলেন, তারা জানতে পেরেছেন যে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল ও সরকারের কারণে এই প্রতিবেদন দাখিল করেনি বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। তারা বলেন, আজকের এই ঘটনার দায়-দায়িত্ব অ্যাটর্নি জেনারেলের। আজকের ঘটনা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়।
‘মেডিকেল প্রতিবেদন তৈরি হয়েছিলো আগেই’
আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চ ২৮ নভেম্বর এক আদেশে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে জানাতে বিএসএমএমইউর উপাচার্যকে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে এদিন খালেদা জিয়ার জামিন বিষয়ে আদেশ দেওয়ার দিনও ধার্য করেন আদালত।
কিন্তু শুনানির দিন ৫ ডিসেম্বর বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ মেডিকেল প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেনি বলে আপিল বিভাগকে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল। একইসঙ্গে শুনানি পিছিয়ে দেয়ার আবেদনও করেন তিনি। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, আদালতের নির্দেশে ৪ ডিসেম্বর রাতেই খালেদা জিয়ার শারিরীক অবস্থা নিয়ে বিএসএমএমইউ’র চিকিৎসকরা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। কিন্তু সরকারের কারণে সেই প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়নি। ওই দিন রাতেই যে প্রতিবেদন তৈরি এবং জমাও হয়েছে গণমাধ্যমেও সেই খবর এসেছে। ৪ ডিসেম্বর রাত ১১ টা ৫৩ মিনিটে দেশের একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমও খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্যের বরাত দিয়ে এই খবর প্রকাশ করে। ‘খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত মেডিকেল বোর্ড। বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাত পৌনে বারোটার দিকে বোর্ডের অন্যতম একজন চিকিৎসক এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’ তবে আর কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিকেল বোর্ডের এই সদস্য। শুধু তাই নয় মেডিকেল বোর্ডের ওই প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা সংগ্রহও করেছেন এবং আদালতে জমাও দিয়েছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদন ৪ ডিসেম্বর রাতেই তৈরি হয়েছিল কিন্তু সরকারের চাপের কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা আদালতে জমা দেয়নি। বিএনপির অভিযোগ, খালেদা জিয়ার জামিন শুনানির ঠিক আগের দিন তার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্য সরাসরি আদালতের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। ‘খালেদা জিয়া রাজার হালে আছেন’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করেছে। যে কারণে তারা খালেদা জিয়ার প্রতিবেদন দেননি। তবে প্রতিবেদন জমা না দেয়ায় আদালত অবমাননা হয়েছে বলেও বিএনপি অভিযোগ করেছে।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত বছর ২৯ অক্টোবর খালেদা জিয়াকে সাত বছর কারাদ- দিয়ে রায় ঘোষণা করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। এরপর এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে জামিনের আবেদন করা হয়। হাইকোর্ট গত ৩১ জুলাই জামিনের আবেদন সরাসরি খারিজ করে দেন। এই খারিজের রায়ের বিরুদ্ধে গত ১৪ নভেম্বর আপিল করেন খালেদা জিয়া। সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালত মিলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এখন ১৭টি মামলা বিচারাধীন। এ পর্যন্ত দুটি মামলায় (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা) তার ১৭ বছর সাজা হয়েছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজার বিরুদ্ধে করা আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন। আর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছর সাজার বিরুদ্ধে করা আপিলটিও আপিল বিভাগে বিচারাধীন। ওই দুই মামলায় জামিন পেলেই মুক্তি পেতে পারেন খালেদা জিয়া। তিনি বর্তমানে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের প্রিজন সেলের কেবিনে চিকিৎসাধীন।
শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে যাচ্ছে?
খালেদা জিয়ার জামিন শুনানির জন্য ১২ ডিসেম্বর নতুন করে দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ। এদিন জামিন না হলে একতরফা আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তবে সেই আন্দোলনের রূপরেখা কেমন হবে তা এখনই স্পষ্ট করে বলা যায় না। বিএনপি নেতারা বলছেন, ‘জামিনের বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া দেখে কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যখন গণতন্ত্রের জায়গা বন্ধ হয়ে যায়, তখন রাজপথেই তার সমাধান করতে হবে।’ এদিকে আগামী ১১ ডিসেম্বর হোটেল লেক সোরে কূটনীতিকদের দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাবে বিএনপি।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন