‘বিষ দেছি, এইলা সবজি খাইয়া মানুষের ক্ষতি হবে জানি। কিন্তু কি করিমো? এই ছাড়া তো হামার ফসল রক্ষা করিবার আর অন্য কোনো উপায় নাই।’
পিঠে কীটনাশক প্রয়োগের স্প্রে মেশিন নিয়ে উঠতি আগাম জাতের শীতকালীন সবজি ফুলকপির ক্ষেতে কীটনাশক (বিষ) প্রয়োগের সময় এভাবেই অকপটে কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার চৌপুকুরিয়া গ্রামের সবজি চাষী রথিকান্ত রায়।
কী কীটনাশক দিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, দোকানত যাইয়া ক্ষেতের পোকার কথা কহেছি- দোকানদার যেইলা বিষ দেছে-ওইলায় ছিটাছি।
বাজারে নিয়ে যাওয়ার দু-একদিন আগে ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ করা এসব সবজি খেলে তো মানবদেহের ক্ষতি হবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে রথিকান্ত বলেন, দুই দিন বিষ না দিলেই পোকা আক্রমণ করেছে। বুঝা পাছি এইলা খাইয়া মানুষের ক্ষতি হবে। কিন্তু হামাকও তো ফসল আবাদ করিবা হবে। বিষ ছাড়া তো উপায় নাই।
একই গ্রামে পার্শ্ববর্তী বেগুনক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ করছিলেন প্রায় ৭০ বছর বয়সী আরেক কৃষক আবদুল আলী। ক্ষেতে বেগুন বড় হয়েছে। বাজারেও বিক্রি করছেন তিন-চার দিন পরপর। এরপরও বেগুনক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ করছেন।
বেগুনচাষী আবদুল আলী জানালেন, দুই দিন পরপর কীটনাশক প্রয়োগ না করলেই পোকা আক্রমণ করছে বেগুনক্ষেতে। বাধ্য হয়েই বিষ দিতে হচ্ছে। দেড় বিঘা জমিতে ৫০ হাজার টাকা খরচ করে বেগুন আবাদ করেছেন। ইতিমধ্যেই ৪০ হাজার টাকার বেগুন বিক্রি হয়েছে। আরও ৪০ হাজার টাকার বেগুন বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা তার।
ওই এলাকার সবজিচাষী আবু সাঈদ, ভোগনগর গ্রামের সাঈদুল ইসলামসহ অন্য চাষীরা জানালেন একই কথা। বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, করলা, শাকসহ বিভিন্ন সবজিচাষী বিকাল হলেই পিঠে বিষ প্রয়োগের স্প্রে মেশিন নিয়ে ছুটছেন ক্ষেতে।
এসব সবজি বাজারে নিয়ে যাওয়ার ১৫ থেকে ২১ দিনের মধ্যে কীটনাশক প্রয়োগে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানছেন না কেউই। কীটনাশক প্রয়োগের দু-তিন দিন পরই বিষ মিশ্রিত এসব সবজি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাজারে।
সবজিক্ষেতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের কথা স্বীকার করে দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ তৌহিদুল ইকবাল জানান, মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনাও মানছেন না তারা। তারা কীটনাশক দোকানদারের পরামর্শে এসব কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তদারকি করলেও সব সময় তো আর পাহারা দেয়ার সম্ভব নয়।
তবে কৃষকদের সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আরও ৪-৫ বছর সময় লাগবে। বীরগঞ্জের কবিরাজহাট এলাকার কীটনাশক দোকানদার জানান, কৃষকরা সবজিক্ষেতে পোকা দমনে কীটনাশক ব্যবহার করছে। এতে তাদের বিক্রিও বেশ বেড়েছে।
কি কি কীটনাশক বিক্রি করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কৃষকরা যা চাচ্ছে, তাই দেয়া হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের কাগজ ছাড়া কৃষকদের কাছে কীটনাশক বিক্রি করা হচ্ছে কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, সব সময় কৃষকরা কাগজ আনতে পারেন না।
এ বিষয়ে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড সায়েন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আনোয়ারা আক্তার খাতুন জানান, সবজিতে কীটনাশক প্রয়োগের অন্তত ১৫ থেকে ২১ দিন পর তা খাওয়ার নিয়ম। কিন্তু এক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। এসব সবজি খেয়ে মানুষের কিডনি ও লিভার ড্যামেজ, হৃদরোগ ও ক্যান্সারসহ ভয়াবহ রোগ হতে পারে। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন