দেশের বিভিন্ন কারাগারে মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়া ১ হাজার ৭৪৯ জন বন্দীর জীবন কাটছে মানবেতরভাবে। সেলের চেয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়া বন্দীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় তাদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।
কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, কারা বিধি অনুযায়ী একজন মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়া বন্দীর থাকার জন্য ৩৬ স্কয়ার ফুট মাপের একটি বিশেষ কক্ষ বরাদ্দ থাকে। ওই কক্ষকে বলা হয় কনডেম সেল। সেই একজনের সেলে এখন অবস্থান করছেন পাঁচ থেকে সাতজন। কোথাও কোথাও এর সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন। কেন্দ্রীয় কারাগারগুলোতে মৃত্যুদ- পাওয়া কয়েদিরা কিছুটা সুবিধা পেলেও জেলা কারাগারগুলোতে তাদের অবস্থা খুবই করুণ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের ৩১ আগস্ট সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ছয় মাসের নিচে ২০৫ জন, ছয় মাস থেকে এক বছর ৯৭ জন, এক থেকে তিন বছর ৫২০ জন, তিন থেকে ছয় বছর ৪১২ জন, ছয় থেকে আট বছর ১১০ জন, ১০ থেকে ১২ বছর ২৮ জন, ১২ থেকে ১৫ বছর ৫০ জন, ১৫ বছরের ওপরে আটজন, অসম্পূর্ণ তথ্য ৪২ জনসহ মোট ১ হাজার ৫০৬ জন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কয়েদি আছে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন ছয় মাসের নিচে ১২ জন, ছয় মাস থেকে এক বছর ১০ জন, এক থেকে তিন বছর ৫৬ জন, তিন থেকে ছয় বছর ৬০ জন, ছয় থেকে আট বছর ২৯ জন, আট থেকে ১০ বছর ১১ জন, ১০ থেকে ১২ বছর ২৪ জন, ১২ থেকে ১৫ বছর ৩৪ জন, ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে একজন এবং অসম্পূর্ণ তথ্য ছয়জনসহ মোট ২৪৩ জন কয়েদি রয়েছে। এই হিসাবের পর গত দেড় মাসে সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে কমপক্ষে আরও ১৫ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয় আদালত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কারা কর্মকর্তা বলেন, মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়া বন্দীদের নিয়ে তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে জেলা কারাগারগুলোতে এমনিতেই জনবল কম। কম জনবল দিয়ে দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করা কষ্টসাধ্য। এর মধ্যে মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়া কয়েদিদের পাহারা দেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক একজন করে কারারক্ষীকে দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে একটি সেলের জন্য একজনকে না রেখে পাঁচ ছয়টি সেলের জন্য একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। আদালত সূত্র জানায়, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মামলায় ১৮ বছর আগে বিচারিক আদালত জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ (অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর) আট আসামিকে মৃত্যুদ- দেয়। সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ- অনুমোদন) ও আপিল এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। একইভাবে আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বিচারিক আদালত ১৪ জনকে মৃত্যুদ- দিয়েছিল পাঁচ বছর আগে। সেটাও এখনো হাই কোর্টের অনুমোদনের অপেক্ষায়। এরকম বিভিন্ন মামলায় মৃত্যুদন্ডের সাজাপ্রাপ্ত ১ হাজার ৭০৪ আসামি কারাগারের কনডেম সেলে চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাদের অনেকের মামলা হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। আবার অনেকের ডেথ রেফারেন্স শেষ হওয়ার পর আপিল করেছেন। সেটা আপিল বিভাগে বিচারাধীন। উচ্চ আদালতে থাকা এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কারা কর্মকর্তাদের মতে, পেপারবুক তৈরিতে দেরি হওয়ায় ডেথ রেফারেন্স বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। বছরের পর বছর ধরে এসব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় আসামি ও বিচারপ্রার্থীরা হতাশায় দিন কাটান। মৃত্যুদন্ডের আদেশ হওয়া এসব আসামিকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে রাখার ফলে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আবার এই বিপুলসংখ্যক আসামির জন্য অর্ধেকের বেশি কারারক্ষীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে তারা অন্য আসামিদের দেখাশোনা করতে পারেন না। আবার কোনো কোনো মামলার ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজা উচ্চ আদালতে কমে যেতেও পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন