সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার পাঁচ বছর বয়সী শিশু তুহিনকে জবাই করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল গাছের ডালে। ঝুলন্ত সেই লাশের পেটে ঢুকানো দুটি ছুরি। কেটে নেওয়া হয়েছে ওর দুই কান, এমনকি শিশ্নও। হত্যাকাণ্ডের জেরে গ্রেপ্তার শিশুটির চাচা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তুহিন ঘুমন্ত অবস্থায় ওর বাবার কোলে ছিল। আর জবাই করেছে ওর চাচা। সুনামগঞ্জের এসপি মিজানুর রহমানের ভাষ্য, জমিজমা নিয়ে পারিবারিক বিরোধ ও মামলার জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ওর জন্মদাতা বাবা ও চাচারা মিলে।
কোমলমতি শিশু এখন বড়দের পারিবারিক বিরোধ কী প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিশোধের সহজ নিশানায় পরিণত হয়েছে। শিশুদের ওপর সহিংসতা দিনদিন বেড়েই চলেছে। গত পাঁচ বছরে দেশে ১ হাজার ৬৩৪ শিশুকে হত্যা করা হয়। আর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ বছরের ৯ মাসে হত্যা করা হয়েছে ৩২০ শিশুকে। সর্বশেষ, গত রবিবার দিনগত রাতে তুহিন হত্যাকাণ্ডে সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়; বিবেকবান মানুষমাত্রই শিউরে ওঠেন। এর রেশ কাটতে না কাটতেই গতকাল মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার ধামরাইয়ে চার বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক, জমিজমা কিংবা ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে সারাদেশে এমন নির্যাতনের হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। শত্রুকে পরাস্ত করতে টার্গেট করা হচ্ছে শিশুকে। মানসিক ব্যাধির কারণে ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। ক্ষেত্রবিশেষে আইনের আওতায় আনা গেলেও অপরাধীরা যথোপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছে, এমন নজির বিরল।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৯ শিশুকে। অপহরণের পর হত্যার শিকার ২৩ শিশু। এ ছাড়া প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোসহ বিভিন্ন কারণে খোদ জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীর হাতেই নিষ্ঠুর-নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে ২৮ শিশু।
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা আমাদের সময়কে বলেন, সমাজের কিছু মানুষের মধ্যে পাশবিকতা ঢুকে গেছে। তাদের জিঘাংসার শিকার হচ্ছে শিশুরা। তার মতে, প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রেই দ্রুত বিচার হলে আমাদের আর এমনটা দেখতে হতো না।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) বলছে, সারা দেশে শিশুদের ওপর নির্যাতন ছাড়াও হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে বেশি হচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। তালিকায় এর পরই আছে যথাক্রমে সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী ও মুন্সীগঞ্জ। ১৫টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে বেসরকারি সংস্থাটি। প্রসঙ্গত শিশু অধিকার বিষয়ে কাজ করে এমন ২৬৯টি বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলোর জাতীয় নেটওয়ার্ক বিএসএএফ।
গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর ডেমরায় একটি বাসা থেকে ফারিহা আক্তার দোলা (৫) ও নুসরাত জাহান (৪) নামে দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় গোলাম মোস্তফা ও আজিজুল ইসলাম বাওয়ানি নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে মামলাটি এখনো বিচারাধীন।
২০১৫ সালের ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে খুঁটিতে বেঁধে ১৩ বছরের শেখ সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে হত্যাকারীরাই সেই নির্যাতনের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিলে সারাদেশে চরম ক্ষোভ ও আলোচনার সঞ্চার হয়।
সারাদেশে এ ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামলে মাত্র ১৭ কার্যদিবসে বিচারিক কার্যক্রম শেষ করে সিলেটের মহানগর দায়রা জজ আদালত ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর প্রধান আসামি কামরুলসহ চারজনকে ফাঁসি ও সাতজনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড। তবে আসামিপক্ষের আবেদনে মামলাটি উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে রয়েছে।
২০১৬ সালের ৩১ মে বরগুনার তালতলীতে ১১ বছরের শিশু রবিউলকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ওই মামলার পরের বছর ৩ আগস্ট জেলা আদালত আসামিদের ফাঁসির আদেশ দেন। এ ছাড়া হত্যার পর লাশ গোপন রাখার একজনকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে। একই সময়ে গাজীপুরের টঙ্গীতেও মোজাম্মেল হোসেন মাজু নামের ১৬ বছরের এক কিশোরকে শেকলে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ওই ঘটনারও রায় হয়েছে। এসব সাধারণ মানুষের মধ্যে সমালোচনা ও ক্ষোভের কারণে দ্রুত বিচার হলেও অধিকাংশ ঘটনার বিচার হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা রাজধানী শহর। এখানে বিভিন্ন ধরনের অপরাধপ্রবণতার পাশাপাশি নানা জেলার মানুষ বসবাস করছে। এ জন্য অন্যান্য অপরাধ কর্মকাণ্ডের মতো ঢাকায় শিশুরাও নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। কিন্তু পুণ্যনগরী সিলেটে শিশুদের ওপর নির্যাতন বা হত্যার পেছনে কতিপয় মানুষের মধ্যে বিত্তবৈভবের প্রভাব, সামাজিক কুসংস্কার আর নেতিবাচক আচরণ দায়ী। তবে কিছু এলাকা আছে অপরাধপ্রবণ। নদী এলাকায় এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন মো. মাহবুব উল আলম আমাদের সময়কে বলেন, বিচার হয় না বলেই শিশুদের ওপর নৃশংসতা। সমাজে যাদের মধ্যে এক ধরনের অপরাধ প্রবণতা রয়েছে, প্রতিটি ঘটনায় দ্রুত বিচার হলে এদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হতো। এতে শিশুদের ওপর নিষ্ঠুরতা কমে আসত। তিনি বলেন, শিশুরা শারীরিকভাবে দুর্বল, তাদের প্রতিরোধ করা ক্ষমতা নেই। এ জন্যই দুর্বৃত্তরা শিশুদের টার্গেট করছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, হত্যাকাণ্ড বা শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে উঠে আসছে। এতে মামলা হচ্ছে। কিন্তু হত্যা বা শারীরিক নির্যাতনের বাইরে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনায় লোকলজ্জা ও স্থানীয় সালিশের চাপে আড়াল থাকে। নির্যাতনের শিকার হয়ে চেপে থাকার এ মানসিকতা তৈরি হয়েছে বিচারহীনতার কারণে।
গত শনিবার বাগেরহাটের শরণখোলায় ৯ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে থানায় মামলা হয়েছে। এ অভিযোগে গ্রামের তরুণ সাব্বিরের (২৫) নামে মামলাটি দায়ের করা হয়। গত ১০ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার চুয়ারিবাড়ি এলাকায় এক আত্মীয়ের হাতে দেড় বছরের শিশু ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে বাংলাদেশে ৩৯৯জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন বলেন, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা মামলায় মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়। দ্রুত সময়ে বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার প্রবণতা কম।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, শিশু সুরক্ষায় রাষ্ট্রে যেসব আইন রয়েছে, সেগুলো মানলেই শিশুরা নিরাপদে থাকবে। এটা রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার আমাদের সবার কর্তব্য।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন