২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আড়াই শয়ের বেশি লোক। এ মামলা তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ জজ মিয়াকে গ্রেফতার করে। নির্যাতন চালিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল তাকে। খবরে শিরোনামে উঠে আসে জজ মিয়ার নাম। তবে তার জবানবন্দির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল।
সরকার পরিবর্তনের পর ২০০৯ সালে কারাগার থেকে ছাড়া পান জজ মিয়া। কিন্তু ততদিনে জীবন থেকে ঝরে গেছে মূল্যবান পাঁচটি বছর।
ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম প্রধান চরিত্র মো. জালাল ওরফে জজ মিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সাড়ে ১০ বছর চলছে। কিন্তু আমার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। আমি কেমন আছি এটার আর কেউ খোঁজ নেয় না। আমাকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। রিমান্ডের নামে সাজানো জবানবন্দি আদায়ে দীর্ঘ এক মাস ধরে আমার ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। জবানবন্দি না দিলে ক্রসফায়ারের ভয়ও দেখায়। এত নির্যাতন সহ্য করার পরও আজ পর্যন্ত আমি এর কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। জজ মিয়া জজ মিয়াই রয়ে গেলাম।
পুলিশের নির্যাতনের বিষয়ে জজ মিয়া বলেন, প্রথমে আমাকে গ্রেনেড হামলার ভিডিওগুলো দেখানো হয় এবং বলে ভিডিওতে যেভাবে হামলা করা হয়েছে সেরকম জবানবন্দি দিতে। আমি মিথ্যা জবানবন্দি দিতে অস্বীকার করলে প্রথমে আমাকে অমানসিক নির্যাতন করে এবং পরে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে জবানবন্দি নেয়। সেখানে সিআইডির তিন জন কর্মকর্তা ছিলেন বলে জানান তিনি। তারা হলেন—এস এস রুহুল আমিন, এএসপি মুন্সী আতিক এবং এএসপি আবদুর রশিদ।
গ্রেফতার হয় কোথায় থেকে এমন প্রশ্নের জবাবে জজ মিয়া বলেন, গ্রামের মোকছেদ চৌকিদার আমারে বলতাছে- জজ মিয়া তোমার নামে থানায় কম্পিলিন আছে। দারোগার লগে থানায় দেখা কর। কিছু সময় পর কবির দারোগা মোটরসাইকেলে আইস্যা আমারে হ্যান্ডকাফ লাগাইয়া ফেলাইল, কোনো কথা নাই।
জজ মিয়া জানান, তাকে সেনবাগ থানায় নিয়ে আসার পর হাজতখানায় রাখা হয়। ঘণ্টা তিনেক পর সিআইডির এসপি আবদুর রশীদের নেতৃত্বে একটি টিম সেনবাগ থানায় যায়। এ সময় রশীদ থানায় গিয়ে জজ মিয়াকে খোঁজেন। এরপর থানা থেকে পুলিশের সব সদস্যকে বের করে দেওয়া হয়। কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে হাজতখানা থেকে জজ মিয়াকে একটি কক্ষে নেওয়া হয়। বলা হয় জজ মিয়া গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিল। সিআইডির কথায় রাজি না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন।
জালাল কিভাবে জজ মিয়া হলেন এমন প্রশ্নের জবাবে জানান, ২১ আগস্টের ঘটনার অনেক আগে নোয়াখালীর সেনবাগের গ্রামের বাড়িতে যুব কল্যাণ ফান্ড নামে একটি সমিতি গঠন করেন তিনি। ওই সমিতিতে বিচার শালিস হতো। সমিতির একটি পদে থাকার সুবাদে তাকেই অনেক সময় বিচার করতে হতো। এক পর্যায়ে তার নাম হয়ে যায় জজ মিয়া। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় বসবাস জজ মিয়ার। একটি আউটসোর্সিং কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার পরিবারে আছেন স্ত্রী, এক সন্তান ও ছোট বোন।
নিজের পরিবার সম্পর্কে জজ মিয়া বলেন, ছেলের শোক এবং মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আঠারো মাস আগে তার মা জোবেদা বেগম মারা গেছেন। আগেই আমার মামলা চালানোর জন্য মা ভিটামাটি সব বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেক কষ্ট কইর্যা তার চিকিৎসা করাইছিলাম। এর আগে দুবার বিয়ে কইর্যাও বউ রাখতে পারি নাই। ২১ আগস্টের বিষয়টি জানার পর আতঙ্কে বউয়ের গার্জিয়ানরা তাগো মাইয়া লইয়্যা যায়।
কেন কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি এমন প্রশ্নে জজ মিয়া বলেন, অনেকেই অনেক রকম আশ্বাস দিয়েছেন; কিন্তু ১৪ থেকে ১৫ বছরেও কেউ আজ পর্যন্ত আমার জন্য কিছুই করেননি। এখনো আমাকে প্রাইভেট কোম্পানির গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। সবাই শুধু আশ্বাস দিয়েই দায়মুক্ত হয়ে যায়। আমি চাই আমার যারা ক্ষতি করেছে তারা যেনো এর উপযুক্ত শাস্তি পায়। মানসিক যন্ত্রণা ভুলে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই।
পূর্বপশ্চিমবিডি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন