মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিখোঁজের মিথ্যা তথ্য দিয়ে নালিশ দেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেত্রী প্রিয়া সাহা। হোয়াইট হাউসের ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে হইচই পড়ে যায় নেট দুনিয়ায়। ট্রাম্পের কাছে করা প্রিয়ার অভিযোগের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান বাংলাদেশিরা। উঠে দেশদ্রোহীতার প্রশ্নও।
শুধু নেটজেনরা নয়, ২০ জুলাই বাংলাদেশের নজরে আসা প্রিয়া সাহার নালিশ নিয়ে বিতর্কে শাসকদল আওয়ামী লীগ, ১৪ দল এমনকি সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কিন্তু একদিন পরই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নরম মনোভাব দেখা গেছে। যদিও এ নিয়ে দেশে এখনো আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম লিখেছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নালিশ করায় প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের নিন্দা বর্ষণের মধ্যেই নরম মনোভাব নিয়ে চলার নির্দেশ দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শাসক দল আওয়ামী লীগের যে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শনিবারেও প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে ‘দেশদ্রোহী’ কাজ বলে কঠোর শাস্তি দাবি করেছিলেন, তিনিই পরেরদিন রবিবার সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে জানিয়েছেন- প্রিয়া সাহার ব্যাখ্যা না-শুনে কোনও আইনি ব্যবস্থা না-নেয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘প্রিয়া সাহা যে অভিযোগ করেছেন, তা উদ্দেশ্যমূলক। প্রিয়া দেশে ফিরলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি যা বলেছেন এ বিষয়ে তথ্য প্রমাণ যদি না পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, বাংলাদেশ বিরোধী মন্তব্য করায় প্রিয়া সাহাকে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তার এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে আমাদের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যোগাযোগ করছে। সব বক্তব্য, তথ্যপ্রমাণ তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাংলাদেশে চলমান সব উন্নয়ন, গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে এটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র।’
তাদের বক্তব্যের পরেরদিন রবিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার দেয়া বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে গেছে, এটা বোধ হয় ঠিক না। তবুও স্বাধীন বিচার বিভাগে বিচারকেরা যেটা মনে করবেন সেটাই করবেন।
এর মধ্যেই ইউটিউবে একটি ভিডিও পোস্ট করে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন প্রিয়া সাহা। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, সরকারি তথ্য থেকেই তিনি তার পরিসংখ্যান পেয়েছেন। ১৯৪৭-এ ভারত ভাগের সময়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছিলেন জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। এখনকার বাংলাদেশে তা কমে ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যাগত চিত্রটা আসলে কেমন? আর প্রিয়া সাহার বক্তব্য কতটা বাস্তবসম্মত?
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি বলছে, ব্রিটিশ আমলের পূর্ববঙ্গ, পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকিস্তান আর বর্তমান বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে জনসংখ্যার একটা হিসাব পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে হওয়া আদমশুমারিতে। এসব তথ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোতে রক্ষিত আছে।
সেখানে আদমশুমারির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ৪৭ এর ভারত ভাগের পর থেকে এ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আর এখনকার বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কখনোই দেড় কোটি ছাড়ায়নি।
১৯৫১ সালে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিলো ৯৭ লাখ ৬ হাজার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে এ সংখ্যা হয় ১ কোটি চার লাখ ৩৯ হাজার। আর সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে এই সংখ্যা ১ কোটি ৩৮ লাখ। অর্থাৎ এই ভূখন্ডে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কখনোই ৩ কোটি ৭০ লাখ বা এর অর্ধেকও ছিলো না।
তবে মোট জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আনুপাতিক হার অবশ্য কমেছে। তবে এই কমে যাওয়ার পরিসংখ্যান শুধু পাকিস্তান আমলে কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরই যে দেখা যাচ্ছে তেমন নয়। বরং ব্রিটিশ আমলেও এই অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের আনুপাতিক হার কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি চীন, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, ইয়েমেন, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমারসহ ১৬টি দেশে সংখ্যালুঘা মানুষদের কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল হোয়াইট হাউসে। গত ১৬ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন তারা।
ট্রাম্প যখন একে একে সবার বক্তব্য শুনছিলেন তখন প্রিয়া সাহা নিজেকে বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘স্যার, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সেখানকার ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ‘নাই’ হয়ে গেছে। দয়া করে বাংলাদেশি জনগণকে সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই।’
ট্রাম্প তখন বলেন, ‘বাংলাদেশ?’ জবাবে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে ওই বাংলাদেশি নারী আরও বলেন, ‘এখনও সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু মানুষ থাকে। আমার অনুরোধ, দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা দেশ ছাড়তে চাই না। সেখানে থাকতে আমাদের সহযোগিতা করুন। আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি। তারা বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার জমি ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কোনও বিচার হয়নি।’
কারা তাদের নির্যাতন করছে ট্রাম্প জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মুসলিম মৌলবাদী ও উগ্রপন্থীরা এ কাজ করছে এবং সবসময় তারা রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে।’
হোয়াইট হাউসের এই ভিডিও ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়েছে। এ নিয়ে হইচই পড়ে গেছে নেট দুনিয়ায়। ট্রাম্পের কাছে করা প্রিয়ার অভিযোগের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন ব্যবহারকারী বাংলাদেশি নাগরিকরা। উঠেছে দেশদ্রোহীতার প্রশ্নও।
প্রিয়া সাহা বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘শারি’-এর নির্বাহী পরিচালক। এছাড়া, বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার স্বামী মলয় সাহা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক। কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রিয়া সাহার দুই মেয়ে বসবাস করছেন। কিছুদিন পূর্বে সেখানে যান প্রিয়া সাহা।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন